মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩, ০৮:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বন্ধ থাকুক পাপের প্রথা

বন্ধ থাকুক পাপের প্রথা

বিশ্বের মুসলমানরা যাপন করছে রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের মাহে রমজান। মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির এক পুণ্যময় আবহ জেগে উঠেছে পবিত্র এ মাসে। রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী-মিলন থেকে বিরত থেকে ঐশী বিধান পালনের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে মুসলিম উম্মাহ। রমজান মাসে দিনভর উপোস থেকে ইফতার করাটা মুমিনদের কাছে অনেক আনন্দের। সারা দিনের রোজার ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে মনে অপার্থিব আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে ইফতার। রোজাদার কেমন আনন্দ অনুভব করে তা কেবল যারা রোজা রাখে তারাই অনুধাবন করতে পারেন। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে—একটি হলো ইফতারের সময় (এ সময় যে কোনো নেক দোয়া কবুল করা হয়)। অন্যটি হলো (কেয়ামতের দিবসে) নিজ প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (বুখারি : ৭৪৯২)। সন্ধ্যায় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর রোজাদার ব্যক্তি যে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করে রোজা ভাঙেন, সেটাকেই ইফতার বলা হয়। আরবি ইফতার শব্দের অর্থ কোনো কিছু খেয়ে রোজা ভাঙা। এটি আরবি ‘ফুতুর’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘ফুতুর’ এর অর্থ নাশতা করা বা হালকা খাবার খাওয়া। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর রোজা সমাপ্তির জন্য পানাহার করাকে ইফতার বলা হয়। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাতের আগমন ঘটে। তখন ইফতার করার সময় হয়ে যায়।

রোজা, সেহরি, ইফতার ও রমজান মাসের আনুষঙ্গিক কাজগুলো নবীজী (সা.) কীভাবে করতেন, মুসলমানদের কর্তব্য সেটা অনুসরণ করা। কারণ আমল সহিহ হওয়ার জন্য নবীজীর দেখানো পথ অনুসরণ করা জরুরি। নবীজী (সা.) ইফতার শুরু করতেন সাধারণ খেজুর দিয়ে এবং ইফতার খুবই সাদামাটা। সালমান ইবনে আমির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দিয়ে; নিশ্চয়ই পানি পবিত্র।’ (আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬২)। অন্য হাদিসে আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, ‘নবীজী (সা.) মাগরিবের নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (তিরমিজি : ৬৩২)। অন্য হাদিসে ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) মাগরিবের নামাজের আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যেত, তবে শুকনো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি শুকনা খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ৩/১৬৪)। এটাই ছিল বিশ্বনবী (সা.)-এর ইফতারির নমুনা।

অনেকে মনে করেন, ‘রমজান মাসে সেহরি ও ইফতারে যত ইচ্ছা তত খাও, আল্লাহতায়ালা এই খাওয়ার হিসাব নেবেন না।’ যদিও ইসলামের কোথাও এমন কথা বলা হয়নি। বরং এটা করতে নিষেধ করা হয়েছে কোরআন-হাদিসের অনেক জায়গায়। নবীজী (সা.) অতিভোজন পছন্দ করতেন না কখনোই। মিকদাম ইবন মাদিকারাব (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, পেটের চেয়ে াামন্দ কোনো পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মতো কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আর বেশি খাবার ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য আর বাকি তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’ (তিরমিজি : ২৩৮৩)। এ হাদিসে পরিমিত খাবারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ অপরিমিত খাবার মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। সাহাবায়ে কেরামও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ পছন্দ করতেন না। আতিয়্যাহ বিন আমির আল-জুহানি বলেন, আমি সালমান (রা.)-এর নিকট শুনেছি, তাকে আহার করতে পীড়াপীড়ি করা হলে তিনি বলতেন, আমার জন্য যথেষ্ট যে আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুনিয়াতে যেসব লোক ভূরিভোজ করে, তারাই হবে কেয়ামতের দিন অধিক ক্ষুধার্ত। (ইবনে মাজাহ : ৩৩৫১)

রমজান মাসে ইফতার করা যেমন সুন্নত, তেমনি ইফতারে পরিমিতিবোধ বজায় রাখাও সুন্নত। আরেকটি সুন্নত হচ্ছে অন্যকে ইফতার করানো। ইসলামে অন্যকে খাওয়ানো, দাওয়াত দেওয়া বা হাদিয়া পাঠানো উত্তম ও প্রশংসনীয় বিষয় বলে বিবেচিত। আপনার খাবার খেয়ে অন্যরা যে নেক আমলের শক্তি পাবে, এতে আপনারও সওয়াব হবে। যায়েদ ইবনে খালেদ আল-জুহানি (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদার ইফতার করাবে সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’ (তিরমিজি : ৮০৭)। তবে এটা হতে হবে পারস্পরিক সৌজন্যবোধ থেকে এবং দ্বিপক্ষীয়। একপক্ষীয় কোনো দাওয়াত বা দাবি করা অনুচিত। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মুসলিম সমাজে ইফতারের নামে কিছু সামাজিক অনাচার ও জুলুমের ঘটনা দেখা যায়। এটা কেন্দ্র করে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সামনে আসছে বিগত বছরগুলোতে।

সমাজের ধনী-গরিব ও শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মহলেই নীরব ঘাতক যৌতুকের চর্চা রয়েছে। বিভিন্ন মৌসুমি খোলসে যৌতুকের দানবীয় উপস্থিতি বহু মানুষকে পিষ্ট করে চলেছে। বিয়ের দিন যে যৌতুক বরপক্ষ উসুল করে, আমাদের সমাজ সেটাকে হয়তো খাটো চোখে দেখে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, বিয়ের কিছুদিন পর থেকে বিরামহীন যৌতুকের ধারাবাহিকতা শুরু হয়, তাকে কিন্তু সমাজ বিশাল সম্মানের বিষয়ই মনে করে থাকে। বিয়ের দিনের যৌতুক তো শুধু ভূমিকামাত্র। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন মৌসুমি ছদ্মনামে যৌতুক আদায়ের মহোৎসব। যেমন—রমজানে ইফতারি পাঠানো, ঈদুল ফিতরে সেমাই-চিনি, ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু, ফলের মৌসুমে মৌসুমি ফল ইত্যাদি। এর ধারাবাহিকতা যেন মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নামে সারা বছরই লেগে থাকে, যা আদায় করতে গিয়ে কনেপক্ষ হয়ে পড়ে দিশেহারা।

কারও কারও ক্ষেত্রে শরণাপন্ন হতে হয় সুদি মহাজনের কাছে কিংবা কখনো হারিয়ে ফেলতে হয় নিজেদের শেষ সম্বলটুকু। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও টানাপোড়েনের এই কঠিন সময়েও সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়দের চাপে পড়ে দিতে হয় ইফতারি, ঈদ উপহার, মৌসুমি ফলসহ নানা রঙের যৌতুক, যা অনেকটা অন্যায়ভাবে উপহার আদায়ের নামান্তর। অথচ অর্থনৈতিক লেনদেনের মৌলিক বিধান সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না এবং এ উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে মামলা কোরো না যে মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে গ্রাস করার গুনাহে লিপ্ত হবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)

আবার অনেক সময় যেসব কনের বাবা সচ্ছল, তারাও মেয়ের বাড়িতে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন অহেতুক বাড়তি জিনিসপত্র দিয়ে সমাজের অন্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। মেয়েকে সন্তুষ্টচিত্তে কিছু দিতে চাইলে এমনভাবে দেওয়া উচিত, যাতে অন্যরা এ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়। কারণ বেশিরভাগ মানুষই লোকলজ্জার ভয়ে পড়ে নিজের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও এ নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এখানে কনেপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে তার পরিবার থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করা হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা কাউকে জুলুম করে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে বলেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। নবীজীর চাচাতো ভাই আলী (রা.) ও কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ের ঘটনায় কিছু মানুষ যৌতুকের পক্ষে প্রমাণ ভেবে ভুল করেন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রাসুল (সা.) শৈশবেই পিতাকে হারিয়ে চাচা আবু তালেবের অভিভাবকত্বে প্রতিপালিত হন। অতঃপর আবু তালেব ইন্তেকাল করলে তার শিশুপুত্র আলি (রা.)-কেও আল্লাহর রাসুল (সা.) শুকরিয়া হিসেবে নিজের অভিভাবকত্বে নিয়ে আসেন এবং আল্লাহর রাসুলের (সা.) বেড়ে ওঠেন আলি (রা.)। অর্থাৎ আল্লাহর রাসুল (সা.) একই সঙ্গে বর-কনে উভয়ের অভিভাবক ছিলেন। তাই বিয়ের সময় আলি (রা.)-কে সামান্য কিছু ব্যবহারিক জিনিস দিয়েছিলেন উভয়ের অভিভাবক হিসেবে। হাদিসে এসেছে, ‘প্রিয়নবী (সা.) তার মেয়ে হজরত ফাতেমার (রা.) বিয়েতে তার সংসারের জন্য একটি সাদা পশমি চাদর, একটি পানির মশক এবং ইজখির ঘাসভর্তি একটি বালিশ উপহার দিয়েছিলেন।’ (নাসায়ি : ৩৩৮৪)। কন্যাপক্ষকে কোনো কিছু দিতে বাধ্য করা, চাপ সৃষ্টি করা বা পরিস্থিতি তৈরি করা যৌতুক হিসেবে বিবেচিত—যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। নবীজী (সা.) বলেন, ‘কারও ধন-সম্পদ তার পূর্ণ সন্তুষ্টি ব্যতীত বৈধ নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০৬৯৫)। আর রমজানের মতো পবিত্র মাসে ইফতারপ্রথার মাধ্যমে জুলুম করা তো অনেক ভয়াবহ শাস্তির বিষয়। এতে রমজানের মাহাত্ম্য যেমন নষ্ট হয়, মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টিও অর্জিত হয়। রমজান হোক সংযমের, সুন্দরের ও আত্মশুদ্ধির। পুণ্যের মাসে বন্ধ থাকুক ভূরিভোজ ও শ্বশুরবাড়ির ইফতার নামক পাপের সমাজপ্রথা।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাবদাহে ঝরছে লিচুর মুকুল, দুশ্চিন্তায় দিনাজপুরে চাষিরা

তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে কুমিল্লায় গাছ লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ

ফরিদপুরের ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে : আব্দুর রহমান

২৪ ঘণ্টায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২ কর্মী খুন

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিপদে জর্ডান

‘হারল্যান স্টোর’ মিরপুর-১০ শাখার উদ্বোধন করলেন নুসরাত ফারিয়া

ভোলায় হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু

ফিতরা জাকাতের টাকা চেয়ে খুদে বার্তায় প্রতারণার ফাঁদ

এক সপ্তাহের মধ্যেই পরমানু বোমার ইউরেনিয়াম পাবে ইরান!

ননদের বিয়েতে টিভি উপহার দিতে চাওয়ায় স্বামীকে হত্যা

১০

মেঘনা নদীতে ভেসে এলো খণ্ডিত পা

১১

ঈশ্বরদীতে হিটস্ট্রোকে স্বর্ণকারের মৃত্যু

১২

সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাইক’ পুরস্কৃত

১৩

নারী চিকিৎসকের সেবা নেওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি : গবেষণা

১৪

সরকারকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল

১৫

দেশে ফিরে কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারা

১৬

হরমোনজনিত সমস্যায় দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ, জানেন না ৯০ শতাংশই

১৭

আনু মুহাম্মদের পায়ে আবারও অস্ত্রোপচার করা হবে

১৮

বুয়েটে হিযবুত ও শিবিরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশই শুধু সমস্যা!

১৯

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে সংবর্ধনা দিল বিমান 

২০
*/ ?>
X