সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৮:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাণের মূল্য না থাকলে যা হয়

প্রাণের মূল্য না থাকলে যা হয়

প্রবল বিস্ফোরণে কাঁপল দেশের প্রধান দুই শহর। প্রথমে চট্টগ্রাম, এরপর ঢাকা। চট্টগ্রামে সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের আতঙ্ক না কাটতেই, রাজধানীতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আরেক বিস্ফোরণ এবং এর রেশ না যেতেই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে আরও বড় বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত ছিল যে, একজনের দেহ ভবন থেকে উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছে। যেহেতু ঘটনাগুলো পরপর ঘটেছে তাই একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠেছে যে, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কোনো অন্তর্ঘাতমূলক কাণ্ড। এগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি না, সেটা নিশ্চয়ই গোয়েন্দারা দেখবেন। নাশকতার কথা মাথায় এলে কোনো বিশেষ পক্ষকে দায়ী করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এবং সেটা হলে ঢাকা বা চট্টগ্রামসহ আমাদের বড় শহরগুলো যে ক্রমেই মৃত্যুর আয়োজন পূর্ণ হয়ে রয়েছে সে আলাপটা বাদ পড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আগুন কেন লাগে? বিস্ফোরণ কী থেকে হয়? কারণ সন্ধান করলে প্রথমেই চোখে পড়বে সব ধরনের নিরাপত্তা বিধিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করবার প্রবণতাটি সর্বত্র বিরাজমান। সিদ্দিকবাজারের ভবনটির কথাই ধরা যাক। এ ভবনটি প্রথমে ছিল দোতলা। এরপর এটি উপরের দিকে উঠেছে। ১৯৯২ সালে নির্মিত এই ভবনের কোথায় সেপটিক ট্যাঙ্ক, কোথায় সুয়ারেজ লাইন, কোন দিক থেকে এসেছে তিতাস গ্যাসের লাইন, কোন তলায় কতগুলো এসি বসানো, সেটা কেউ বলতে পারেনি ঘটনার পর। ব্যাংক আছে, দোকান আছে, রেস্তোরা আছে। তিতাস গ্যাসের লাইন ছাড়াও সিলিন্ডার গ্যাসও অনেক অফিসে। এত যে কাণ্ড সেগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কি ছিল কোথাও? এ কথার উত্তর হবে না। প্রথমেই আসা যাক ভবনটি নিয়ে। নিশ্চিত যে, এটি বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। ফলে এর কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। ভবন উপরের দিকে উঠেছে, এসি বসেছে একের পর এক। কখনো সেগুলোর সার্ভিসিং বা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি ঠিক আছে কিনা, কোনো ঝুঁকি আছে কিনা। গ্যাস লাইনে কোথাও ফাটল আছে কিনা, গ্যাস জমে থাকছে কিনা কোথাও, সিলিন্ডারগুলো ঠিক আছে কিনা সেসব জানার চেষ্টা হয়নি কখনো। সেপটিক ট্যাঙ্কে আবর্জনা জমে ভয়ংকর গ্যাস বোমা তৈরি হয়ে থাকতে পারে, সেটাও কখনো ভাবা হয়নি।

আমাদের জীবন সংস্কৃতিই, ব্যবস্থাপনাই তাই। গাদাগাদি করে যেনতেনভাবে বিল্ডিং উঠে, কোনো সেফটি প্ল্যান বা ব্যবস্থা থাকে না, বিল্ডিং কোড মানার তো প্রশ্নই নাই। আগুন লাগতে পারে এই ভাবনাটাই নাই, তাই আগুন লাগলে কীভাবে বের হতে হবে সেই রাস্তা থাকে না, ব্যবস্থাও থাকে না। শহরে মাটির নিচ দিয়ে গেছে গ্যাস নামক বিস্ফোরক লাইন। কেউ তার নকশা জানে না। স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করা হয় না কোনোদিন এবং সেখানে গ্যাস জমে জমে বোমা তৈরি হয়। অর্থাৎ দুর্ঘটনার সব আয়োজন রেখে আমরা দুর্ঘটনা ঘটলে আহাজারি করছি।

কয়েকটি পুরোনো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে। মারা যায় ৩৪ জন। তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, মসজিদের ভেতর গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন দুটোই অবৈধ ছিল। গ্যাস লাইনে লিকেজ হয়ে বের হওয়া গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটে। ২০২১ সালে মগবাজারে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ ঘটে। সেই ভবনের নিচতলায় কোনো গ্যাস সংযোগ ছিল না। গ্যাস সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল। কিন্তু পয়নিষ্কাশনের লাইনে আবর্জনা জমে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। আর আগুনের ঘটনাতো বলে শেষ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে নগরায়ণ মানেই হলো আগুন নিয়ে খেলা। যে বহুতলগুলো বিস্ফোরণ বা আগুনের গ্রাসে পড়েছে, আর যেগুলো এখনো পড়েনি তার সবকটিতেই বহু মানুষের বাস, বহু ব্যবসার ঠিকানা। তবু আগুন ও অন্যান্য নিরাপত্তা বিধি মান্য করা হয় না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার লোকও নাই। তাই এতবড় একটা দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র বা পূর্তমন্ত্রীকে দেখা যায় না।

এ ধরনের সব ঘটনাই প্রশাসনিক ব্যর্থতা। কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক গ্রাহকত্বের ভয়াল প্রকাশ। কোনো বাড়িতে বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অগ্নিবিধি বা অন্যান্য নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা দেখবার জন্য বহু সরকারি সংস্থা আছে। কিন্তু এরা কার্যত চোখ বুজে থাকে। এবং এই দায়িত্ব পালনে অনীহা সেটা আসে রাজনীতি থেকে। সরকারি দপ্তরের সবাই এখন রাজনীতি যতটা করে, কাজ করে ততটা কম এবং দায়িত্ব পালন বলে কোনোকিছু এখন এসব সংস্থার সংস্কৃতিতে নেই।

চট্টগ্রামের কথায় আসি। ২০২২ সালের ৪ জুন সীতাকুণ্ড বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ মুছেনি এখনো। ৯ মাস না যেতেই আবারও বিস্ফোরিত হলো সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন কারখানা। এবারের বিস্ফোরণে বহুদূরের জনপদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি এলাকা কেঁপে উঠেছিল। আশেপাশের বহু বাড়ির কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে ৩০০ কেজি ওজনের লোহার খণ্ড উড়ে এসে মাথায় আঘাতে একজন মারা যায়। বিএম ডিপোর ঘটনার পর যদি সব ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা পরিদর্শন করা হতো তাহলে সর্বশেষ মৃত্যুগুলো এড়ানো যেত। তেমনি বনানির এফ আর টাওয়ারের আগুনের পর যদি ঢাকায় পালাক্রমে সব উঁচু ভবন পরিদর্শন করে ঝুঁকি চিহ্নিত করা হতো তাহলে আজ মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গু হওয়া দেখতে হতো না।

কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে যে প্রাণের কোনো মূল্য নেই। শহরের অনেক বহুতল আবাসনেরই দমকলের ছাড়পত্র নাই। অনেক জায়গাতেই অগ্নিনির্বাপণের মহড়া হয় না। আগুনের শিখা নিবে গেলে আমরা কিছু কথা বলে সব ভুলে যাই পরবর্তী অগ্নিকাণ্ড পর্যন্ত। আমাদের নাগরিকদের মধ্যেও রয়েছে নিরাপত্তাবিধিকে অবজ্ঞা করার অঢেল প্রবণতা। কর্তৃপক্ষ এবং মানুষ– উভয়পক্ষেই অদ্ভুত প্রবণতা হলো—এখানে নিরাপত্তাবিধি নির্মাণ ন্যূনতম প্রয়োজনীয় স্তরের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাবদাহে ঝরছে লিচুর মুকুল, দুশ্চিন্তায় দিনাজপুরে চাষিরা

তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে কুমিল্লায় গাছ লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ

ফরিদপুরের ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে : আব্দুর রহমান

২৪ ঘণ্টায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২ কর্মী খুন

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিপদে জর্ডান

‘হারল্যান স্টোর’ মিরপুর-১০ শাখার উদ্বোধন করলেন নুসরাত ফারিয়া

ভোলায় হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু

ফিতরা জাকাতের টাকা চেয়ে খুদে বার্তায় প্রতারণার ফাঁদ

এক সপ্তাহের মধ্যেই পরমানু বোমার ইউরেনিয়াম পাবে ইরান!

ননদের বিয়েতে টিভি উপহার দিতে চাওয়ায় স্বামীকে হত্যা

১০

মেঘনা নদীতে ভেসে এলো খণ্ডিত পা

১১

ঈশ্বরদীতে হিটস্ট্রোকে স্বর্ণকারের মৃত্যু

১২

সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাইক’ পুরস্কৃত

১৩

নারী চিকিৎসকের সেবা নেওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি : গবেষণা

১৪

সরকারকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল

১৫

দেশে ফিরে কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারা

১৬

হরমোনজনিত সমস্যায় দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ, জানেন না ৯০ শতাংশই

১৭

আনু মুহাম্মদের পায়ে আবারও অস্ত্রোপচার করা হবে

১৮

বুয়েটে হিযবুত ও শিবিরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশই শুধু সমস্যা!

১৯

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে সংবর্ধনা দিল বিমান 

২০
*/ ?>
X