ভাষা আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। ভাষার লড়াই থেকেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধিকার আন্দোলন। আর স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ; কিন্তু স্বাধীনতার সাত দশক পরেও সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়নি। বাংলা ভাষার দুর্গতি এখন অবর্ণনীয়। ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে আমারা অনেকটাই দূরে সরে গেছি। আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে দিচ্ছি। পাঠাচ্ছি মাদ্রাসায়; কিন্তু ভাষা আন্দোলনে কথা ছিল—একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এবং সেটি মাতৃভাষার মাধ্যমে। সেই লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে গেছি। ফলে একদিকে যেমন বাংলা গুরুত্ব পাচ্ছে কম, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করছে তারা দ্রুত চাকরি পাচ্ছে, বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে একটি বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
সর্বস্তরে ভাষার প্রচলন চালু তো হচ্ছেই না। যে যার খুশিমতো চলছে। এই নিয়ে সরকারের কোনো নীতি আছে বলেও মনে হয় না। নামমাত্র সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। আছে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি। এ ছাড়া আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট; কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান কী করে, সেখানে কী কাজ হয়, তা কেউ জানে না। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় বাংলা ভাষার আজ সীমাহীন দুর্গতি।
ভাষা আসলে অনুভব বা অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। মানুষ তার আবেগ-অনুভূতি নানা ভাষায় ব্যক্ত করে। কিছু আবার আছে চিরায়ত ভাষা বা ভিন্ন রকম ভাষা। এই ভাষার কোনো নাম নেই। যেমন—একটা হাসি, সমুদ্রের ঢেউ বা চোখের জলের ভাষা কী? একটা শিক্ষিত বেকারের চাকরি খোঁজার লড়াইয়ের ভাষা কী? প্রেমের ঝগড়ার ভাষা কী? সন্তান জন্মের পর মায়ের আনন্দাশ্রুর ভাষা কী? পাহাড়শৃঙ্গ থেকে নদী যখন লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্তিকায় আছাড় খায় তখন তার ভাষা কী? ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, স্প্যানিশ, জার্মান কী ভাষায় এ অনুভূতি ব্যক্ত হয়?
ভাষা আসলে একটা সর্বজনীন চরিত্র। যার গন্ধ নেই, আকার নেই, স্বাদ নেই আছে কেবল জন্মের ইতিহাস, বিবর্তন আর অনুভব। একটা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও তৈরি হয়েছিল ভাষার লড়াইয়ে। উর্দু নয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। মাতৃভাষার এ লড়াই আজ কেবল বাঙালির নয়, বিশ্বজনীন।
ভাষাশহীদদের উৎসর্গিত জীবন, আত্মবলিদান মাতৃত্ববোধের এক অনবদ্য স্থাপত্য সৃষ্টি করে গিয়েছে। ভাষার নিরিখে দেশের নাম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন পতাকা, একটি চেতনা এবং বাংলা আমাদের অনুভব প্রকাশের ভাষা! এত গর্ব, এত উল্লাস, এত আত্মগরিমার পরও আমরা আজ কেমন যেন উদাসীন আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে। আমরা আজও জোর দিয়ে বলতে পারি না, ভাল ভাবে, শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে-পড়তে শেখো। বাংলাতে স্থিত হও। তার পরও মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে আমাদের যতটুকু, যা আবেগ কাজ করে তা এই ফেব্রুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারি গেলে আমাদের আবেগ কমে যায়। বাংলার গুরুত্বও কমে। যদিও ভাষা একটি অন্য জিনিস; কিন্তু আমাদের দেশে এটা হয়ে উঠেছে আয়-রোজগার-দক্ষতার একটি উপকরণ!
ইংরেজি জানতেই হবে, নাহলে সভ্য সমাজে জীবন আর জীবিকার লড়াইয়ে হার মানতে হবে! ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও করপোরেট সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এই মতই অল্প অল্প করে গ্রাস করছে আমাদের, আমাদের যুব সমাজকে। এখন করপোরেট অফিসে চাকরি করতে হলে ইংরেজি বলা শিখতেই হবে। তা না হলে শতগুণেও মূল্যহীন হবে যুবকের কষ্টার্জিত জ্ঞান! ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাড়ছে ‘বাংরেজি’ (অল্প কিছু বাংলার সঙ্গে অনেক বেশি ইংরেজি মেশানো) ভাষায় কথা বলার প্রভাব। এই পরিস্থিতিতে আমরা কেমন করে বলি, আমার সন্তানকে আমি বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াব? আমাদের চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি কিন্তু বাংলা নয়, বরং ইংরেজি চর্চাকেই প্রতিনিয়ত উৎসাহ জোগাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে পারিবারিক জীবন পর্যন্ত অর্থাৎ জীবনের সর্বত্র ইংরেজি ভাষার দাপট। যে ছাত্র ইংরেজিতে ভালো, সে শিক্ষাজীবন শেষে ভালো ভালো চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে। যে ব্যবসায়ী ভালো ইংরেজি জানেন, তিনি ব্যবসায় উন্নতি করছেন।
শিক্ষার অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য যাই হোক না কেন, বাহ্যিক লক্ষ্য এখন ভালো চাকরি পাওয়া। আর দেশের চাকরির বাজার, চাকরিদাতাদের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের দাবি অনুযায়ী যে ইংরেজিতে দক্ষ তার চাহিদা সর্বত্র। সার্টিফিকেটকে চাকরিপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করার স্বীকৃতি বলা যেতে পারে; কিন্তু চাকরির বাজারে প্রবেশের চাবি অবশ্যই ইংরেজিতে অনেক দক্ষ হওয়া। শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে চাইলেও ইংরেজি জানা চাই। একজন ইংরেজি ভাষা না-জানা শ্রমিক যে টাকা মাইনে পান তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মাইনে পান একজন ইংরেজি ভাষা জানা শ্রমিক। দুজন শ্রমিকেরই কাজ করার যোগ্যতা সমান হওয়ার পরও এটাই বাস্তবতা।
ইংরেজি ভাষা জানা ছাড়া আজকের দুনিয়ায় মানুষকে পিছিয়ে পড়তে হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা আমাদের এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে। এর পেছনে আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ থেকে বেরোতে পারিনি বলেই হয়তো ইংরেজি ভাষার প্রতি আমাদের মোহটা একটু বেশি। আদপে এই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লোক যে ভাষায় কথা বলে, সেটি চীনা ভাষা। ১৫ শতাংশ। তারপরে আসে ইংরেজি, ১২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর ৮৮ শতাংশ লোক ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলেন। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানটাই বুঝিয়ে দেয়, ইংরেজি ছাড়া অন্য বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্বটা; কিন্তু আমরা অন্যসব ভাষাকে পায়ে মাড়িয়ে ইংরেজির কোলেই কেবল আশ্রয় খুঁজেছি। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত কর্মসংস্থান। আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক সংস্থাগুলো ইংরেজিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। বিদেশি ভাষা শেখার তিনটি দিক আছে ব্যক্তিগত আগ্রহ, সহজবোধ্যতা আর কর্মসংস্থানের চাহিদা। আমরা শেষেরটিকে বড় করে দেখি। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিদেশি ভাষা নয়, ইংরেজিই আমাদের প্রথম ও প্রধান পছন্দ। তাই ইংরেজি হয়ে উঠেছে আমাদের আয়-উন্নতির একমাত্র ভাষা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে সামাজিক উত্তরণের কার্যত একমাত্র পথ হলো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জন করা। ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথের বাইরে টাকা উপার্জনের প্রধান ক্ষেত্র হলো করপোরেট দুনিয়ায় চাকরি করা। আর এই জগতে কাজ করতে হলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অপরিহার্য।
আমাদের দেশে ‘সামাজিক চাহিদা’ বর্তমানে ইংরেজিমুখী। রাষ্ট্রীয় নীতিও এই সামাজিক চাহিদার অনুগামী। দেশে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল, উৎপাদন শিল্পও প্রায় নেই বললেই চলে। জনসংখ্যায় তরুণের অনুপাত বিরাট। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে উপার্জননির্ভর একটি শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা অভ্যস্ত হতে চলেছি। সেখানে ইংরেজিটাই হয়ে উঠছে প্রধান অবলম্বন। আর বাংলাভাষা ক্রমে ‘বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো’ এক ভাষায় পরিণত হয়েছে। যে ভাষা জেনে চুপচাপ বসে থাকলে আয়-উন্নতির তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, বড় হওয়া যেমন-তেমন, বড়লোক হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই!
বাংলা আসলে একটা দীর্ঘশ্বাসের নাম। বাংলা যারা চর্চা করে, তারা সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। বাংলা পরিণত হয়েছে গরিব মানুষের ভাষায়। বাংলা নিয়ে পড়ে থাকলে গরিব থাকতে হবে। সবার পেছনে দাঁড়াতে হবে।
প্রায় একশ বছর আগে পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা বলেছিলেন, ইংরেজি হলো ‘বিদেশি ভাষা’। তিনি এই ভাষা বোঝা এবং তা নির্ভুলভাবে লিখতে পারার মধ্যে একটা পার্থক্য করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, ইংরেজিকে দখলে আনতে হলে ‘সময়, চর্চা এবং দীর্ঘ অনুশীলন’ দরকার; কিন্তু তার মতে ইংরেজির একটা ‘পর্যাপ্ত’ জ্ঞান অর্জন করা হলো ‘জাতীয় প্রয়োজন’ এবং ‘দৈনন্দিন গুরুত্ব’-এর ব্যাপার এবং সে কারণে তিনি সুপারিশ করেছিলেন, ‘ইংরেজি নির্ভুলভাবে লেখা নয়, এই ভাষা বুঝতে পারা এবং ইংরেজি বই স্বচ্ছন্দভাবে পড়তে পারার দক্ষতা অর্জন প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পক্ষে জরুরি, এটি করতে পারলেই ভাষা সমস্যার সমাধান হবে।
আমরা সেই পথ ধরিনি। আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার জন্য অশ্রুপাত করি। আর বাকি এগারো মাস ইংরেজির আরাধনা করি। তাতে বাংলাভাষা হয়তো বেঁচে-বর্তে থাকবে; কিন্তু যারা বাংলা নিয়ে বসে থাকবে, তাদের না খেয়ে মারা-পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী