মোনায়েম সরকার
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপির জন্য সুখবর আছে কি

বিএনপির জন্য সুখবর আছে কি

বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের গত ছয় মাসের ক্রমধারা উল্লেখ করে একটি জাতীয় পত্রিকা শিরোনাম করেছে ‘দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বিএনপি’। বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে। বিভাগীয় সমাবেশের সর্বশেষটি ছিল ঢাকায়। ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। কিন্তু ঢাকার সমাবেশ থেকে যে কর্মসূচি দেওয়া হয় তা অনেকটা দপ করে জ্বলে উঠে আবার হঠাৎ নিভে যাওয়ার মতো।

১০ ডিসেম্বরের আগে অনেকে ভেবেছিলেন ওই দিনই বুঝি সরকার ফেলে দেবে বিএনপি। কেন এমন ধারণা করা হচ্ছিল? বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করেছিলেন, অবিলম্বে পদত্যাগ না করলে আওয়ামী লীগ নাকি পালানোর পথ পাবে না! আমানউল্লাহ আমান নামের বিএনপির এক নেতা তো বলে ফেলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। ওই হুমকি যে একটি কথার কথা ছিল, সেটা বুঝতে জনগণের কিছুটা সময় লেগেছে।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ১১ মার্চ ময়মনসিংহে দলীয় এক বিশাল জনসমাবেশে বলেছেন, ‘মিথ্যা বলা, দুর্নীতি ও লুটপাট করা বিএনপির অভ্যাস।’ শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করা কঠিন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেও এমন কথার কথা অনেক বলেছিলেন। যেমন নৌকায় ভোট দিলে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে কিংবা আওয়ামী লীগ আগামী ৫০ বছরেও আর ক্ষমতায় যেতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটলে এমন আরও অনেক আজগুবি রাজনৈতিক বক্তব্য পাওয়া যাবে। এখন বেগম জিয়া সরকারি বিধিনিষেধের আওতায় থাকায় তার রাজনৈতিক বক্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। কিন্তু তার সমর্থক ও অনুসারীরা অহেতুক উত্তেজনা ছড়ানোর দায়িত্ব ঠিকই পালন করে যাচ্ছেন।

২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। ২০১৮ সালে অংশ নিলেও প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে দায়সারাভাবে মাঠে নেমে মানুষের সমর্থন না পেয়ে ক্ষমতার বাইরে আছে দলটি। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে দলের নেতারা বলে আসছেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে দলটি কোনো নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, না হলে পতন চায়। বিএনপি লক্ষ্য পূরণের জন্য গত কয়েক মাস ধরে দলীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে সরকারবিরোধী সব দলকে একমঞ্চে আনতে বা অন্তত যুগপথ আন্দোলনে শামিল করতে তৎপর রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি আছে বলে মনে হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবাই চায়। তবে যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক না কেন, বেশিরভাগ দলের কোনো নেতারই বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থন ছাড়া জেতা সম্ভব নয়। আন্দোলনের ব্যাপারে একমত হলেও নির্বাচনের বিষয় সামনে এলে ঐক্যের প্রশ্ন নড়বড়ে হয়ে ওঠে। অন্য দলের নেতাদের খামোখা জিতিয়ে আনার আগ্রহ বড় দলের না থাকাই স্বাভাবিক।

বিএনপির মিত্র দলের নেতাদের একটি তালিকা করলেই বোঝা যায়, তাদের কয়জনের জয়লাভের সম্ভাবনা আছে! আবার ওইসব নেতা এতবেশি ডিগবাজি খেয়ে অভ্যস্ত যে, তাদের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে। উদাহরণ হিসেবে দুয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এখন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার মাহমুদুর রহমান মান্না। মান্না আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে দুবার নির্বাচন করেও জিততে পারেননি। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জিতবেন, তার নিশ্চয়তা কি? ধানের শীষের যে প্রার্থীকে বঞ্চিত করে তাকে মার্কা কর্জ দেওয়া হবে, সেই বঞ্চিতজন কি তাকে জেতানোর চেষ্টা করবেন? বিএনপির পক্ষের আরেক খাম্বা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনিও কি নির্বাচনে জেতার মতো জনপ্রিয় ব্যক্তি? বিএনপির কোনো নিশ্চিত আসন তাকে উপহার দিলে যদি তার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। এভাবে আরও যত নেতার নামই উল্লেখ করা হোক না কেন, সবাই তো জাতীয় নেতা, নির্বাচনী এলাকা নেই কারও।

এসব নেতাকে নিয়ে আন্দোলন করা যায়, নির্বাচন করলে কি ভালো ফল পাওয়া যাবে? কেউ কেউ এ জন্যই মনে করেন, বিএনপির নির্বাচনে অনাগ্রহ। তবে সরকার মনে করছে, বিএনপি এখন মুখে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপির উপায় থাকবে না। এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। সরকারের সঙ্গে বিএনপির একটি অংশ যোগাযোগ করছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে।

সরকার মনে করছে, আগের দুটি নির্বাচন যতটা অনায়াসে পার হওয়া গেছে, আগামী নির্বাচন ততটা সহজে পার হওয়া যাবে না। দেশের ভেতরে যেমন চাপ থাকবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের, দেশের বাইরে থেকেও তেমন চাপ থাকবে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব একতরফা সংসদ দেখতে চায় না। সেদিক থেকে এবারের সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা বাড়িয়ে একটি সমঝোতা হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়াকে বিএনপির কৌশল হিসেবে ধরে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় আরও কাছাকাছি এলে বিএনপি হুট করে তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না প্রকাশ্যে বারবার বললেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য আছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। সেই সময় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য দেশজুড়ে আন্দোলনও করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেও একই দাবি করেছিল। বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর তারা দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে এবার কোনো সংলাপ হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন। আগেরবার সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলেই মনে করেন তিনি। শেখ হাসিনা একাধিকবার এটা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিএনপি তো জনগণের কাছে যেতেই ভয় পায়। জনগণের সামনে ভোট চাইতে গিয়েও ভয় পায়।’

ময়মনসিংহের জনসভায়ও শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তার ছেলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত। যেখানে তারেক ও কোকোর দুর্নীতি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বেরিয়েছে। এখন দেশ থেকে ভেগে আছে আর আওয়ামী লীগ সরকারের করে দেওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে রাজনীতি করে।’

বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচনে বড় সমস্যা হবে তাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে সামনে আনা হবে, সেটা। বেগম জিয়া শারীরিকভাবেই নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় নেই। বিএনপির সামনে ভবিষ্যৎ হলো তারেক রহমান। কিন্তু তারেকের যে ভাবমূর্তি তা কি বিএনপির জন্য বড় অ্যাসেট হবে?

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা নস্যাৎ করতে সরকারের তরফে নানামুখী কৌশল নেওয়া হবে। আবার বিএনপি যদি সহিংসতার পথে হাঁটে তাহলে সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধা হবে। এমনিতেই বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। সামনে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিএনপির আশঙ্কা। অন্যদিকে বিএনপির আশা, যেহেতু সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান এবং টানা কোনো দলের ক্ষমতায় থাকা যেহেতু অনেকেরই অপছন্দ, সেহেতু এবার বিএনপির আন্দোলনে মানুষ আকৃষ্ট হতে পারে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনসমাগম দেখে বিএনপি উৎসাহবোধ করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখার বিষয় হলো, মানুষের মধ্যে হয়তো আওয়ামী লীগের সমালোচনা আছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়ে উত্তম বিকল্প কি মানুষের সামনে আছে? আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আগ্রহী হলেও আমেরিকার ইচ্ছামতো আর বিশ্ব রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার অবস্থা কি এখন আছে? সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তা আমেরিকার জন্য যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান আমেরিকার খামখেয়ালি বন্ধে কার্যকর দাওয়াই হতে পারে। এ অবস্থায় বিএনপি যদি দেশের রাজনীতির জন্য বিদেশের দিকে বেশি তাকিয়ে থাকে, তাহলে তাদের পস্তাতে হবে না, সেটা কে বলতে পারে?

লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক, মহাপরিচালক বিএফডিআর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

শিল্পী সমিতির নতুন সভাপতি মিশা, সাধারণ সম্পাদক ডিপজল

ডেমরায় যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

ফের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী, নীরব প্রশাসন

ভোটের তিন বছর পর কাউন্সিলর হচ্ছেন আলী আহাম্মদ

পাবনায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ইউপি সদস্যের মৃত্যু

শুধু আ.লীগের লোকজন ভিজিএফ ও টিসিবি কার্ড পাবে

ছেড়ে গেছেন সন্তানরা, সংসার টানছেন ১০৭ বছরের বৃদ্ধা

৫ হাজার টাকায় স্ত্রীকে ‘মাদক কারবারির’ হাতে তুলে ‍দিলেন স্বামী

১০

ব্যারিস্টার সুমনের খেলা দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়

১১

সাতক্ষীরায় এমপির গাড়িতে হামলা

১২

জব্বারের বলী খেলা ২৫ এপ্রিল

১৩

মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিং বডির নির্বাচন অনুষ্ঠিত

১৪

খরুচে বোলিং মোস্তাফিজের, চেন্নাইয়ের হার

১৫

এফডিসিতে ৫৭০ ভোটারের সংবাদ সংগ্রহে ৩০০ সাংবাদিক

১৬

যশোরে অধিকাংশ টিউবওয়েলে মিলছে না পানি

১৭

বিদেশি শ্রমিকদের সুখবর দিল কুয়েত

১৮

এফডিসিতে ফিরেছেন নির্বাচন কমিশনার, খোঁজ নেই নিপুনের

১৯

চাঁদপুরে পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা নিখোঁজের ঘটনায় ৮ কর্মকর্তা বদলি

২০
*/ ?>
X