শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আবেদ খান
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংক্ষুব্ধ ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর

সংক্ষুব্ধ ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি জানান। তখন জেনারেল ওসমানী তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘দোহাই আল্লাহর, আপনাকে প্রেসিডেন্ট হতেই হবে। নইলে আইন বলে কিছু থাকবে না। দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে।’

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাযজ্ঞের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি অবয়বে ফিরিয়ে আনার যে জঘন্য ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, নভেম্বর মাসটিকে বলা যায় তারই ঝঞ্ঝা-সংক্ষুব্ধ খণ্ডচিত্র। বহুমুখী চক্রান্ত, স্বার্থদ্বন্দ্ব, সংকীর্ণ গোষ্ঠীবিদ্বেষ এবং তারই সঙ্গে পাকিস্তান-মার্কিন প্যানইসলামিক অভিসন্ধি একটি নবীন রাষ্ট্রের শরীরটাকে যে বীভৎস ব্যবচ্ছেদ করে চলেছিল, পরবর্তী একুশটি বছর তারই উদ্বোধন ঘটে পঁচাত্তরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। ইত্তেফাক অফিসের সামনে রাখা হয়েছিল গোলাভর্তি একটি ট্যাঙ্ক। তার ওপরে রাখা কামানের মুখটি এমনভাবে তাক করা ছিল, যা সেই একাত্তরের পঁচিশে মার্চকে মনে করিয়ে দেওয়ার মতো। তখন যে কোনো উর্দিধারী সিপাই বা জেসিও পদমর্যাদার অধিকারীদের আস্ফালন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে পঁচাত্তরের ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর দেশে কোনো সরকার ছিল না। এ সময় খন্দকার মোশতাক নামেমাত্র প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু খন্দকার মোশতাকের নামেই চলছিল। প্রকৃতপক্ষে এ তিন দিন খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনেই কাটাচ্ছিলেন।

৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে জিয়া-মোশতাক চক্র পূর্বনির্ধারিত ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী কারাগারের নির্জন সেলে চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চক্রান্তকারীরা হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের।

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান : ৩ নভেম্বর সকালবেলায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবন ছাড়া বাকি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। এদিন সকালে তিনি বঙ্গভবনে টেলিফোন করেন। ফোন ধরে কর্নেল রশিদ—

‘কে?’

‘আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।’

‘বলুন।’

‘তোমরা কী চাও?’

‘মানে?’

‘বলছি তোমরা রক্তপাত চাও, না শান্তি চাও?’

‘শান্তি কে না চায়?’

‘আমাদেরও লক্ষ্য তা-ই। কিন্তু অন্যায়ের চেয়ে, আত্মসমর্পণের চেয়ে রক্তপাতই আমাদের কাম্য।’

কিছুক্ষণ কথা নেই। খালেদ মোশাররফ তার ভেতরের উত্তেজনা কিছুটা সামলে নিলেন। বললেন, একমাত্র তাহলেই শান্তি আসবে, নইলে রক্তপাত অনিবার্য। আর তোমরাই হবে সে জন্য দায়ী। কারণ দেশে তোমরাই রক্তপাত শুরু করেছ। কথাগুলো বলেই খালেদ মোশাররফ টেলিফোন ছেড়ে দেন।

কিছুক্ষণ পরই বঙ্গভবনের গেটে এসে দাঁড়াল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের একটি প্রতিনিধি দল। চারটি শর্ত নিয়ে এসেছে তারা।

এক. ট্যাঙ্কের গোলা ফেরত দিতে হবে।

দুই. গোলাহীন ট্যাঙ্কগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠাতে হবে।

তিন. জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে হবে।

চার. প্রেসিডেন্ট মোশতাক দেশের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন। তবে তাকে পররাষ্ট্রনীতি বদলাতে হবে। অতীতে যারা বাংলাদেশের বন্ধু ছিল, তাদের সঙ্গে আবার সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

কিন্তু খন্দকার মোশতাক জানান, তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধি দল এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা জেনালের ওসমানীকে প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট যখন নাই তখন আমিও নাই। কারণ আমি তো প্রেসিডেন্টেরই সামরিক উপদেষ্টা। সেই প্রেসিডেন্টই যদি না থাকেন, তাহলে আমিই-বা থাকি কী করে?’

প্রতিনিধি দল ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর আবার তারা বঙ্গভবনের গেটে ফিরে আসে। এবার তাদের শর্ত মাত্র দুটি।

এক. গোলাসহ ট্যাঙ্কগুলোকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে দিতে হবে।

দুই. সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অপসারণ করতে হবে।

এরপর চলল দরকষাকষি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যেতে দেওয়া হবে। আর জেনারেল জিয়াও ছাড়বেন সেনাপ্রধানের পদ। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা এ পর্যন্তই এগিয়ে থাকল। এরই মধ্যে জেনারেল ওসমানী বললেন, ‘আমরা ক্লান্ত। ক্ষুধার্ত। আমাদের খাওয়া প্রয়োজন। বিশ্রাম প্রয়োজন।’ জেনারেল ওসমানীর এ প্রস্তাবে খন্দকার মোশতাকও সায় দিলেন। ফলে সেদিনের মতো বঙ্গভবনের প্রকাশ্য তৎপরতা এখানেই বন্ধ হলো।

খালেদ মোশাররফ নতুন সেনাপ্রাধন : ৪ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বঙ্গবভনে আসেন। সঙ্গে ছিলেন মেজর জেনারেল খলিল, এয়ার ভাইস মার্শাল গোলাম তোয়াব এবং নৌবাহিনীর প্রধান এন এইচ খান। তারা নিয়ে এসেছেন জেনারেল জিয়ার পদত্যাগের সংবাদ এবং সেই পদত্যাগপত্র তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তখন খন্দকার মোশতাককে বলেন, ‘এবার তাহলে সেনাপ্রধানের পদে নতুন লোক বসাতে হয়।’

খালেদ মোশাররফের এ প্রস্তাবে খন্দকার মোশতাক একটু চিন্তিত হলেন। তিনি বললেন, ‘তা তো হবেই। বিকেলের দিকে মন্ত্রিপরিষদের সভা ডাকি। সেই সভায় সেনাপ্রধানের নিয়োগের বিষয়টি পাকা করা যাবে।’

বিকেলে যথারীতি বসল‍ মন্ত্রিপরিষদের সেই সভা। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে খালেদ মোশাররফের অন্তর্ভুক্তি এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মোশতাকের অবস্থান সুদৃঢ় করা। জেনারেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ গোলাম তোয়াব, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমানকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক খালেদ মোশাররফ হলেন নতুন সেনাপ্রধান।

খুনি মোশতাকের বিদায় : বৈঠকের শেষ পর্যায়ে জেলহত্যার সেই বীভৎস খবর আসে বঙ্গভবনে। এ খবরে বঙ্গভবনে শুরু হয় গভীর উত্তেজনা। আর নাটের গুরু খন্দকার মোশতাক এমন একটা ভাব দেখালেন যে, তিনি এর কিছুই জানেন না। খুনি মোশতাক বললেন, ‘কাল রাতে ঘটনা ঘটেছে অথচ আমার কাছে খবর এলো আজ বিকেলে। ভারি দুঃসংবাদ! মর্মন্তুদ ঘটনা! এ অবস্থা বিবেচনার জন্য আবার তো মন্ত্রিপরিষদের সভা ডাকতে হয়।’ সভা বসল, আলোচনা চলল। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতিকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হলো। এমন সময় সভাকক্ষের বাইরের দরজায় দারুণ গোলমাল। একটি ছড়ি হাতে জোর করে ঘরে ঢুকলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। সঙ্গে স্টেনগানধারী আরও পাঁচজন অফিসার। তাদের দেখে মন্ত্রীরা পালানোর চেষ্টা করলেন। একজন তরুণ মেজর খন্দকার মোশতাকের মাথায় স্টেনগান ধরতেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এগিয়ে‌ এলেন জেনারেল ওসমানী। ওই তরুণ অফিসারকে বললেন, ‘আল্লাহর দোহাই, ওকে কিছু কোরো না। এটা একটা পাগলামি। তোমরা দেশটাকে ধ্বংস কোরো না।’

উত্তেজনায় কাঁপছেন শাফায়াত জামিল। তার রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। খন্দকার মোশতাককে তিনি বললেন, ‘তুমি খুনি। জাতির পিতাকে তুমি খুন করেছ। খুন করেছ চার জাতীয় নেতাকে। তাই ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার তোমার নেই। এই মুহূর্তে তুমি গদি ছেড়ে দাও।’

জেনারেল খলিলকে ধমক দিলেন কর্নেল জামিল। তার দিকে ফিরে বললেন, ‘জেলে চার নেতার খুনের খবর তুমি তো আগে পেয়েছিলে। তুমি তা চেপে গেলে কেন? তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ‌ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ বেশ কিছুক্ষণ এই উত্তেজনা চলল। যখনই তরুণ অফিসাররা স্টেনগান তাক করে মন্ত্রীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই ওসমানী তাদের সরিয়ে দিচ্ছিলেন। অবশেষে ওসমানী খন্দকার মোশতাককে বললেন, ‘পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আপনি বরং পদত্যাগ করেন।’

ওসমানীর এ প্রস্তাবে খন্দকার মোশতাক মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। অবশেষে এটাই স্থির হলো। সব সামরিক অফিসার ও মন্ত্রীকে চলে যেতে অনুমতি দেওয়া হলেও চারজন মন্ত্রীকে থাকতে বলা হলো। তারা হলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কে এম ওবায়দুর রহমান। তাদের পদত্যাগপত্র লিখতে বলা হলো। তাহের উদ্দিন ঠাকুর জানতে চান তাদের বন্দি করা হয়েছে কিনা। কেউ তাকে পাত্তা দিলেন না। পরে তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরের কয়েক ঘণ্টা বঙ্গভবনে সবাই সরকার পরিবর্তনের কাজে ব্যস্ত রইলেন। খালেদ মোশাররফ কয়েকটি চিঠি তৈরি করলেন খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য। এর মধ্যে একটি ছিল খন্দকার মোশতাকের পদত্যাগ-সংক্রান্ত চিঠি। অন্যটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘাতক দলকে দেশত্যাগের জন্য দায়ী করে লেখা চিঠি এবং জেনারেল ওসমানীর মতে শেষ চিঠিটি ছিল জেলহত্যা-সংক্রান্ত। কিন্তু তাতে কী লেখা ছিল জেনারেল ওসমানী তা বলেননি। তিনি শুধু বলেন, খালেদ মোশাররফ তখন খন্দকার মোশতাককে চাপ দিচ্ছিলেন শেষ দুটি চিঠিতে ৩ নভেম্বরের স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য। কিন্তু এতে খন্দকার মোশতাক অস্বীকৃতি জানান। পরিস্থিতি যখন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল, জেনারেল ওসমানী তখন খন্দকার মোশতাককে বলেন, ‘আপনি সই করুন। যদি কোর্টে মামলা হয় তাহলে আমি আপনার পক্ষে সাক্ষ্য দেব।’

বিচারপতি সায়েমের আগমন : ৫ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার দিকে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বঙ্গভবনে আনা হয়। জেনারেল ওসমানীকে দেখে বিচারপতি সায়েম বলেন, ‘আমাকে কেন বঙ্গভবনে আনা হয়েছে।’

জেনারেল ওসমানী তাকে বলেন, ‘আপনি প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।’

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি জানান। তখন জেনারেল ওসমানী তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘দোহাই আল্লাহর, আপনাকে প্রেসিডেন্ট হতেই হবে। নইলে আইন বলে কিছু থাকবে না। দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে।’

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত হতে চাননি। তিনি খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল, জেনারেল ওসমানী এবং বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাসভবনে যান। তাদের সবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হন। এভাবে পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হন।

খালেদ মোশাররফ অধ্যায়ের যবনিকা : ৭ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যখন রক্তের হোলি খেলা শুরু হয়েছে, তখন সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে। তার সঙ্গে ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব ও নৌপ্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খান। সেখানে ক্ষমতার ভাগবণ্টন নিয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। এমন সময় ফোন গেল ইস্ট বেঙ্গলের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে।

ফোন ধরলেন খালেদ মোশাররফ, বললেন, কী? খবর কী?

‘খুব খারাপ, স্যার। সিপাইরা অস্ত্রপাতি লুটে নিয়েছে। বিদ্রোহ করেছে। ওদের গুলিতে মারা গেছেন অনেক অফিসার।’

ব্যস্তভাবে খালেদ মোশাররফ বললেন, হু তারপর?

‘এখন তো রাত ১টা। এর ভেতরই ওরা সারা সেনাছাউনি দখল নিয়েছে। আমাদের কপালে কী আছে, কে জানে?’

খালেদ মোশাররফ ফোন ছেড়ে দিলেন। চোখেমুখে দারুণ উত্তেজনা। প্রেসিডেন্ট সায়েমকে বললেন, ‘সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটেছে। সাধারণ সৈনিকরা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কাজেই আজ আর বৈঠক নয়। যা করার কাল করা যাবে।’ বলে খালেদ মোশাররফ উঠলেন। প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে বাইরে এলেন। বঙ্গভবনে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল নাজমুল হুদা ও চট্টগ্রামের ৭২ ইনফ্যানট্রি ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হায়দার। তারা তার সঙ্গে চললেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল বঙ্গভবনেই ছিলেন। তিনি থেকে গেলেন।

খালেদ মোশাররফ গেলেন শেরেবাংলা নগরে, দশম ইস্ট বেঙ্গলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। সেখানকার সবাই তার সমর্থক। জায়গাটা তাই তার পক্ষে নিরাপদ। কিন্তু এ যাত্রায় খালেদ মোশাররফ সরকারি গাড়ি নিলেন না। নিলেন তার ব্যক্তিগত গাড়ি। সে গাড়ি ছুটল মিরপুর রোড ধরে শেরেবাংলা নগরের দিকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, নাকি গাড়িচালকের কারসাজি কে জানে! ফাতেমা নার্সিং হোমের কাছে গিয়ে সে গাড়ি বিগড়ে গেল।

আসন্ন বিপদের গন্ধ পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন খালেদ মোশাররফ। গাড়ি থেকে নামলেন। গেলেন পাশের ওই নার্সিং হোমে। আশ্রয়ের জন্য নয়, সেখান থেকে ফোন করলেন তিনি দশম ইস্ট বেঙ্গলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। খবর নিলেন, সেখানকার অবস্থা কেমন। সেখানে সিপাইরা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামেনি তো? ‘নো’ উত্তর এলো ফোনের ওপার থেকে। মোশাররফ আশ্বস্ত হলেন। পায়ে হেঁটেই চললেন তারা শেরেবাংলা নগরে। দশম ইস্ট বেঙ্গলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। রাতটা সেখানে ভালোভাবেই কাটল। সেখানে সিপাইদের হইহুল্লোড় নেই। স্লোগান নেই। সব চুপচাপ। সব নীরব। পরদিন ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠলেন তারা। সৈনিকের পোশাক গায়ে চাপালেন। তারপর এলেন অফিস ঘরে। সৈনিক তাদের নাশতা দিয়ে গেল। তারা নাশতা করলেন।

কিন্তু তার পরই বাইরে চিৎকার। স্লোগান। বেঙ্গল ল্যান্সার ও ২ নম্বর ফিল্ড আর্টিলারির বিদ্রোহী সিপাইরা এসেছে। তারা দশম ইস্ট বেঙ্গল সিপাইদের ডাকছে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। মোশাররফরা উঠে যাচ্ছিলেন অফিস ঘর থেকে। কিন্তু তার আগেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল দুই কোম্পানি কমান্ডার। ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল।

তাদের গুলিতে অফিস ঘরের মেঝেতেই লুটিয়ে পড়লেন খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার। ওদিকে ঢাকার সেনাছাউনিতে তখন আনন্দ-উৎসব। বিদ্রোহী সিপাইরা স্লোগান দিচ্ছে। নাচছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়ছে আকাশের দিকে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জব্বারের বলী খেলা ২৫ এপ্রিল

মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিং বডির নির্বাচন অনুষ্ঠিত

খরুচে বোলিং মোস্তাফিজের, চেন্নাইয়ের হার

এফডিসিতে ৫৭০ ভোটারের সংবাদ সংগ্রহে ৩০০ সাংবাদিক

যশোরে অধিকাংশ টিউবওয়েলে মিলছে না পানি

বিদেশি শ্রমিকদের সুখবর দিল কুয়েত

এফডিসিতে ফিরেছেন নির্বাচন কমিশনার, খোঁজ নেই নিপুনের

চাঁদপুরে পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা নিখোঁজের ঘটনায় ৮ কর্মকর্তা বদলি

বিআরটিএর অভিযানে ৪০৫ মামলা, ১০ লাখ টাকা জরিমানা 

প্রেমিককে কুপিয়ে জখম, প্রেমিকা আটক

১০

আরও ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি

১১

‘গোপালগঞ্জের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ অচিরেই চালু হবে’ 

১২

‘আমাদের নিজেদের এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যেতে হবে’

১৩

শ্যালকের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন পলক 

১৪

উৎকলিত রহমানের কবিতা ‘জ্যোতিষ্ময়ীর গান’

১৫

পাবনায় যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

১৬

পহেলা বৈশাখে প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী

১৭

আবহাওয়া নিয়ে আরও বড় দুঃসংবাদ

১৮

উপজেলা নির্বাচনের নামেও প্রহসন করছে সরকার : ভিপি নুর

১৯

ফ্রান্সের ইরানি দূতাবাসে বোমা আতঙ্ক, আটক ১

২০
*/ ?>
X