নতুন কাশ্মীর ও জি২০ সম্মেলন

নতুন কাশ্মীর ও জি২০ সম্মেলন

এক ব্যক্তি নির্জন পথ দিয়ে যেতে যেতে তার দেবতার উদ্দেশে বলল, হে দেবতা, আমি বড়ই অসহায়-দরিদ্র। আমার দিকে যদি একটু করুণা করতে! দেবতা তার কথা শুনে সামনে নেমে এসে বললেন, বল, তুই কী চাস! লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, বসবাসের কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই, ছাপরাঘরে থাকি। আমাকে যদি একটা বাড়ি দিতে, বড়ই উপকৃত হতাম। দেবতা বললেন, তাই হবে, তবে শর্ত একটাই, তোকে যা দেব, তার দ্বিগুণ দেব তোর প্রতিবেশীকে। লোকটি শুনে বলল, এ আর কী ঘটনা! কোনো ব্যাপারই না। তুমি তাকে যা খুশি দাও। সে বাড়ি পৌঁছে দেখল, তার সুন্দর একতলা একটি বাড়ি উঠে গেছে। পাশের বাড়ির দিকে উঁকি দিয়ে দেখল, সেখানে একইরকম সুন্দর, কিন্তু দোতলা একটি বাড়ি। প্রথম দিন কিছু মনে হলো না। কিন্তু কালক্রমে মনটা তার খুঁত খুঁত করতে লাগল। তার আর ভালো লাগে না। এক সকালে সে একই জায়গায় গিয়ে দেবতাকে ডাকল। দেবতা সাড়া দিলেন। লোকটি বলল, হে দেবতা, আমার বাড়িটা যদি একটু দোতলা করে দিতে! দেবতা বললেন, আচ্ছা তাই হবে। লোকটি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে দেখল তার বাড়িটিও দোতলা হয়ে গেছে। এরপর সে দৌড়ে জানালায় গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, পাশের বাড়ি একইরকম সুন্দর চারতলা হয়ে গেছে। কলজেটা একেবারে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ওদিকে তার স্ত্রীও ঘ্যান ঘ্যান করে খোঁটা দিতে থাকল, মিনসে! কোনো কাজেরই না! পাশের বাড়ি এমন দিনে দিনে উন্নতি করে কীভাবে! লোকটি সারা দিন বাড়িতে পায়চারি করে আর ভাবে কী করা যায়! হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এলো। সে এক দৌড়ে দেবতার কাছে ফিরে গেল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হে দেবতা! আমার আর একটা মাত্র চাওয়া!

‘কী তোর চাওয়া?’

‘আমার এক চোখ কানা করে দাও!’

তার ধারণা, সবকিছুই যখন ডাবল, তখন তার একচোখ কানা হলে প্রতিবেশীর দুই চোখই কানা হয়ে যাবে!

প্রতিবেশীর প্রতি বিদ্বেষের এ গল্প অনেকেরই জানা। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে এ গল্প এতটাই মানানসই যে, পাঠকের সময় নষ্ট না করে পারলাম না। প্রতিবেশী ভারত গত ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে জি২০ গ্রুপের (১৯ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। প্রায় সব অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের এ তালিকায় পাকিস্তানের নাম নেই। ভারত তার বিভিন্ন শহরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জি২০ মিটিং চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে গত এপ্রিল মাসে ভারত কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট ডাল লেক অঞ্চলে অবস্থিত শের-ই-কাশ্মীর ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে ট্যুরিজম ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিংয়ের আয়োজন করেছে। এ সম্মেলন হবে ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত। কিন্তু পাকিস্তান এ সম্মেলনকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশনের বিরোধী বলে অভিযোগ করে আসছে। এ পর্যন্ত বলার কিছু নেই। তারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে কূটনৈতিক বক্তব্য দিতেই পারে। কিন্তু পাকিস্তান এ মিটিং যাতে না হতে পারে তাই সৌদি আরব, তুরস্ক, চীন এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে জোর লবিং চালিয়েছে। তাতে অবশ্য সফল হতে পারেনি। প্রতিটি দেশই এ মিটিংয়ে যোগ দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে।

আমি মিটিংয়ের ঠিক সাত দিন আগে শ্রীনগরের ডাল লেক অঞ্চলে থেকে সেখান থেকে ফিরলাম। রিপোর্টিংয়ের জন্য নয়, স্রেফ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলাম, যেমন শত শত বাংলাদেশি যাচ্ছে। মহাসমারোহে চলছে আরও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গেল এ মিটিং নিয়ে। তারা ধারণা করছে, এরপর কাশ্মীরের চেহারা আরও বদলে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, কাশ্মীরে আমি খুব কমই ছিন্নবস্ত্র, হতদরিদ্র মানুষ দেখেছি। যতটুকু আছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় হতদরিদ্র নিউইয়র্ক, লন্ডন বা প্যারিসে দেখতে পাওয়া যায়। গোটা শ্রীনগরের রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, বাড়িঘর দেখলে মনে হয় সাজানো। সেগুলো তো আর সম্মেলন উপলক্ষে করা নয়। প্রকৃত অর্থে গত চার-পাঁচ বছর ধরে কাশ্মীরের অর্থনীতি যথেষ্ট ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ কিন্তু মোটেই অস্পষ্ট নয়। বিশেষ করে ভারতীয় সংবিধানের স্পেশাল স্ট্যাটাস ৩৭০ বাতিলের পর ভারতের সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে কাশ্মীরের উন্নয়নের দিকে। তারা কাশ্মীরের জনগণের সন্তুষ্টি আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখছে না। ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ট্যুরিজম, কৃষি ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সাড়ে ৫৮ হাজার কোটি রুপির ৫৩টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর ইউনিয়ন টেরিটরিতে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে সরকারের বাজেট অ্যালোকেশন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ সালে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি রুপি, ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি, ২০২১-২২-এ ১ লাখ ৯ হাজার এবং ২০২২-২৩ সালে তা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি রুপিতে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সদক ইউজনা প্রকল্পের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর ইউনিয়ন টেরিটরিতে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়ক এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে অবিশ্বাস্য সব পরিকল্পনা। স্কুল ও কলেজে অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য যথাক্রমে ২০ হাজার ও ৪০ হাজার রুপি বাৎসরিক স্টাইপেন দিচ্ছে সরকার। নতুন দুটি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স, সাতটি নতুন মেডিকেল কলেজ, ১০টি নার্সিং কলেজ, দুটি স্পেশালাইজড ক্যান্সার হসপিটাল নির্মাণ কাশ্মীরের চেহারা বদলে দিয়েছে। নারী উন্নয়নের জন্য তেজস্বিনী স্কিম ভীষণভাবে সাড়া ফেলেছে। আত্মনির্ভর হতে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ লাখ রুপি করে ঋণ সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, কাশ্মীরের নারীরা কিন্তু ঘরে বসে থাকে না। তারা নিজেদের শালীনতা বজায় রেখে হাট, বাজার, কর্মস্থল সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি বিচরণ করছে। যে কেউ ইচ্ছা হলে সে দৃশ্য দেখে আসতে পারেন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অচেনা পুরুষের পাশাপাশি বসে অবলীলায় তারা যাতায়াত করছে।

ফলে সাধারণ কাশ্মীরের জনতার মধ্যে পাকিস্তানের উসকানিতে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা এখন আক্ষরিক অর্থেই স্তিমিত হয়ে গেছে। এখন এতটাই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কাশ্মীরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বড় একটি সংখ্যার মত হচ্ছে, বিতাড়িত হিন্দু পণ্ডিতদের তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনা হোক।

এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের দখলীকৃত কাশ্মীরের জনগণ কেমন আছে? এমনিতেই গোটা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন তা বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষের কাছেও অজানা নয়। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশ হারে। ১১৬টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ৯২। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পাকিস্তানে ৩৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। পাকিস্তান দখলকৃত কাশ্মীরের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। তারা একটি কাজই দীর্ঘকাল ধরে সফলভাবে করতে পেরেছে, তা হলো জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঢুকিয়ে দিয়ে অস্থিরতা তৈরি করা। তারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর নিতে চায় পাকিস্তানের অধীনে, যেভাবে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়ে দখল করেছিল কাশ্মীরের একটি অংশ। না খাইয়ে রাখা ছাড়া আর কী দিতে পারবে এই পাকিস্তান? এটা কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ কাশ্মীরিই বুঝতে পারছে। কাশ্মীরের অনেক তরুণের সঙ্গেই আমার খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।

তারা আশা করছে, এ বছর গ্রীষ্মকালে লাখ লাখ ট্যুরিস্ট প্রবেশ করবে শ্রীনগরে, যা জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর ভারতীয় সরকারের কড়া নিরাপত্তার কারণে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত, যা ট্যুরিজমকে ভীষণভাবে সহায়তা করবে। এখন পাকিস্তানের ঈর্ষা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই। তাই নালিশ করছে বিভিন্ন ফোরামে। ফলে তাদের মানসিকতা ওই হতদরিদ্র লোকটির মতো, হে দেবতা আমার এক চোখ কানা করে দাও!

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com