
নজরুলের সাম্যবাদ আর মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের সাম্যবাদের মাঝে কিছু মৌলিক এবং কাঠামোগত পার্থক্য রয়েছে। মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস যেমন অর্থনৈতিক দিকটিকেই অসাম্যের মূল হিসেবে দেখেছেন এবং তা দূরীকরণে আর্থিক ব্যবস্থাপনাকেই প্রধান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। নজরুল পরাধীন পিছিয়ে পড়া ভারতে অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার পাশাপাশি, কখনো কখনো আর্থিক সংকটের চেয়েও সাম্প্রদায়িকতা, জাতভেদ, সামাজিক কুসংস্কার আরও জনঅনিষ্টকারী উপাদান হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। উপমহাদেশে জন্মে নজরুল অসাম্যের সংকটে মানবতা কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়, তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অর্থ, শ্রম বা জমিজমা, সম্পদ, জানমাল হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও জাতপাত, ধর্ম-অধর্ম কীভাবে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, তার নানা কৌশল বা অপকৌশল তিনি প্রত্যক্ষ করেন কাছে থেকে।
নজরুল সাম্যবাদ তার জীবনদর্শন দিয়ে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাই তিনি সাম্যবাদের চলমান ধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হননি। তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মেদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পার্টিতে যোগ দেননি। কারণ তিনি পার্টির নিয়মকানুন মেনে চলার মতো মানুষ ছিলেন না, তিনি চলতেন আপন খেয়ালে। তিনি যে লিখেছিলেন, ‘আমি দলে যাই যত নিয়ম-কানুনশৃঙ্খল।’ তার এ বক্তব্য শুধু কবিত্বের কথা ছিল না। এ শৃঙ্খল ভাঙার আকুতি তার নিজের স্বভাবের মধ্যেই প্রোথিত ছিল। তাছাড়া প্রথম দিকে তার হৃদয়ে যে অফুরন্ত মানবপ্রেম ছিল, তিনি চেয়েছেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, দরিদ্ররা দুবেলা দুমুঠো খেতে পাবে, শাসকরা তাদের অধীনদের অধিকার বুঝিয়ে দেবে, রাষ্ট্র জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করবে। তিনি এসব কথা তার কবিতা এবং গানের মাধ্যমে সবার মধ্যে উপস্থাপন করেন। তার সেই সময়কালের সাহিত্যকর্মগুলোতে তার প্রকাশ ঘটে। কবি এ সময়ে একগুচ্ছ কবিতা লেখেন, যা ‘সাম্যবাদী’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়। এ কবিতাগুচ্ছ তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর অন্যতম। এ কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘ঈশ্বর’ থেকে শুরু করে ‘চোর-ডাকাত’, ‘কুলি-মজুর’, ‘বীরাঙ্গনা’ ইত্যাদিসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ। কবিতাসমূহে সাম্যবাদ সম্পর্কে কবির ধারণা প্রকাশিত হয়েছে।
যেমন—‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে/এই ধরণির তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!’ অর্থাৎ শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে ওঠে। সুতরাং সভ্যতার পরিচালিকা শক্তি তাদেরই হাতে ন্যস্ত থাকার কথা : এ কবিতাগুচ্ছের প্রথম কবিতা ‘সাম্যবাদী’র বক্তব্যও মূলত এক। এ কবিতায় তিনি বলেছেন, মানুষে মানুষে সব ধর্মীয় এবং জাতিগত ব্যবধান ঘুচে গেছে, ‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান। পারস, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভিল, গারো?’ কারণ, মানুষের ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ এবং ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ ভিখারি, চাষি, চণ্ডাল, রাখাল—মানুষ হিসেবে সবারই অভিন্ন পরিচয়। বিচিত্র নামের আড়ালে এসব কবিতার মূলে আছে মানবপ্রেম এবং শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক সাম্য। এই হলো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার স্বরূপ। এ সময়কার কিছু কবিতায় সমকালীন রাজনীতির কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি ‘সর্বহারা’ ও ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে সামাজিক সাম্য ও দরিদ্রদের অধিকারের কথা লেখেন, তিনি দূর থেকে কুলি-মজুর-চাষি-ধীবর সবার দুঃখে দুঃখিত হয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্রদের জন্য তার অন্তরের গভীর বেদনা প্রকাশ করেন তার কবিতাগুলোর মাধ্যমে। ধনীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন যে, ‘দরিদ্ররা তাদের দ্বারে এসেছে অধিকার নিয়ে, তাদের ভাগ তাদের দিয়ে দাও, নয়তো ওরা কেড়ে নেবে।’ আলোচ্য কবিতাগুলো তাই সাম্যবাদী ও শ্রেণিসংগ্রাম ধারণায় সম্পৃক্ত। কিন্তু এ কবিতাগুলোতে আরেকটি বৈশিষ্ট্য নির্ভুলভাবে দেখা যায়, সে হলো সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে তার নব্য-ধর্মীয় চেতনাও এ কবিতাগুলোয় একাকার হয়ে আছে।
সাধারণভাবে বিশ্বকে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না, এটি অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও মাপা যায় না, এই বিশ্ব কোনো ভাষাভাষী দিয়েও সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ধর্মের সংকীর্ণতা ও ভৌগোলিক বিভাজন যেভাবে মানুষ থেকে মানুষকে পৃথক করেছে, তার সংকট নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে তার জীবনের সুকুমার-সুন্দর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, জীবনের সবচেয়ে নিষ্পাপ চাওয়া, নির্মোহ আকাঙ্ক্ষা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী, পরিচয় মানুষের অধিকার হরণ করে, সম্ভাবনা ধ্বংস করে। তিনি প্রতিষ্ঠিত অনেক শক্তিধর ধর্ম—হিন্দু বা মুসলমান ধর্মের পাশাপাশি জৈন বা নৃগোষ্ঠীর ধর্মকে নিয়ে এসেছেন সমগুরুত্ব দিয়ে। তিনি ইসলামের যে বিশাল শক্তিধর ধর্ম প্রচারের আবেদন তাও সবার সামনে নিয়ে এসেছেন, ঠিক তেমনি কম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা অনুসৃত ধর্ম শিখ ধর্মের কথাও তিনি বলেছেন, তিনি ছোট নৃগোষ্ঠী গারোদের কথা বলেছেন, তিনি আরবের বেদুইনদের কথা বলেছেন, তিনি যিশুখ্রিষ্টের পাশাপাশি ইহুদি ধর্মের কথা বিবেচনায় এনেছেন। তার কাছে কোনো ধর্মই ছোট নয়, নজরুল বিশ্বাস করতেন, আমরা সবাই পিঠে এত ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন, বেদ, ইঞ্জিল, বাইবেলের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, তার কোনো গুরুত্ব নেই। তিনি মনে করেন, এত অবারিত সৌন্দর্যে ভরা বিশাল মাঠের মাঝে যে ফুলের বাগান মানবদৃষ্টিতে অবলোকন করে সবাইকে বিমোহিত করে, সেই সৌন্দর্য যদি তোমাকে টানতে না পারে। তাহলে তুমি কিতাব বা গ্রন্থের ভারে ন্যূব্জ অবস্থা থেকে উত্তরণ পাবে না। ধর্মের যে শক্তি, পেশির যে শক্তি, অসির যে শক্তি তার কাছে তুমি বন্দি হয়ে থাকবে। তোমার হৃদয় তুমি খুলে দেখো ধর্মের সব কল্যাণের বাণী সেখানেই রয়েছে, হোক সে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, ইহুদি, বেদুইন বা গারো। তুমি যদি তোমার হৃদয় খুলে প্রাণ উন্মোচন করে দেখো, তবে তুমি সব ধর্মের শ্রেষ্ঠ মর্মবাণী হৃদয়ের মাঝে দেখতে পাবে। তোমার কিতাবের বোঝায় ন্যূব্জ হয়ে নিঃশেষ হওয়ার কোনোই অর্থই থাকে না। মূল অর্থ তুমি যদি সত্যিকারের ধর্মের যে সুন্দর অমর বাণী, যে বাণী সুন্দর, যে বাণী মুক্তির, যে বাণী কল্যাণের, যে বাণী মানুষকে অমরত্ব দেবে, যে বাণী মানুষের সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বার উন্মোচন করে দেবে, সে বাণী লিখিত আছে তোমার অন্তরে। এটি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফার্সি দিয়ে নয়, এটি জীবনের অমর অক্ষরে লেখা। এ লেখা সাধারণ কালি বা কলম দিয়ে লেখা নয়। অমর বাণীগুলো সেই অলিখিত অনির্ণীত অক্ষরে লেখা যেটি আসলে নির্ণীত হয়েছে মানুষের সৃষ্টির সময়ই, আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। এ আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা ছিল নজরুলের অন্তরে।
তিনি যে সাম্যের কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল মানুষের অধিকারের সাম্য, সেটি শুধু অর্থনৈতিক অধিকার নয়, রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামোর অধিকার নয়, এ অধিকার মানবিক অধিকার, এ অধিকার হলো সাম্যের বাণীর মর্মার্থ। এ অধিকার যদি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে প্রচলিত কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না। যে ভৌগোলিক পরিসীমায় দেশ বিভাজন হয়েছে তার কোনো দরকার হবে না, আধুনিক রাষ্ট্রের ভিসা ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন হবে না। ধর্মের যে গঠনগত ইমারত বা কাঠামোগত নির্মাণ উপাসনালয় বা প্রার্থনালয়, সেটিও প্রয়োজন পড়বে না। এমনকি অর্থনীতির যে নিয়ম বা আইন বা তত্ত্ব যার মাধ্যমে মানুষের সুষম বণ্টনের কথা মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস বা আরও অনেক সাম্যবাদী অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সেটিও জরুরি নয়। মানুষকে উদার হতে হবে, মানুষকে মানবিক হতে হবে, ন্যায়পরায়ণ হতে হবে এবং এই ক্ষুদ্র স্বার্থ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, খণ্ডিত মানসিকতা এবং ধর্মের গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সেখানে একই ধর্মের মাঝে আবার অনেক বিভাজন রয়েছে। সেই ভাগগুলো কোনো ধর্মেই প্রত্যাশিত নয়। আবার একইভাবে ধর্মের বিভাজন সামগ্রিকভাবে সমাজের একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। একইভাবে পুরো বিশ্ব মানবসমাজের মাঝে ধর্মীয় বিভাজনের সংকটের অবসান খুবই জরুরি বলে নজরুল মনে করতেন। তাই তিনি এ সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত সংকট অবসানের লক্ষ্যে তার এ মানবিক সাম্যের কথা এত তেজোদীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। নজরুল প্রকৃত সাম্যবাদী কবি ছিলেন। তার জন্মদিনে সাম্যের তরে নিবেদিত বিশ্বের সব মানুষের পক্ষ থেকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়