তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০টি প্রদেশ। এগুলোর মধ্যে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল হলো কাহরামানমারাস, হাতাই, আদিয়ামান, গাজিয়ান্তেপ ও মালাতিয়া প্রদেশ। ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলোয় এখন চলছে বিধ্বস্ত ভবনগুলোর কনক্রিট সরানো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার কাজ। গত কয়েকদিনে আদিয়ামান, হাতাই, গাজিয়ান্তেপ ও আদানা প্রদেশ ঘুরে দেখা গেল ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ভবনগুলোর ভয়াল সে চিত্র।
তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল আয়তনে প্রায় একটি বাংলাদেশের সমপরিমাণ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল না হলেও বিভাগীয় শহর, জেলা শহরে মানুষের রয়েছে ঘনবসতি। ভূমিকম্পে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশের অন্যতম হচ্ছে হাতাই। ভূমিকম্পে মৃত অর্ধলাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারই হাতাই প্রদেশের। হাতাই অঞ্চলের শহরের মূল জেলা আনতাকিয়া। এখানে কোনো কোনো মহল্লার সড়কের দুপাশের একটি ভবনও অবশিষ্ট নেই। আনতাকিয়ার হাজার বছরের ঐতিহাসিক ‘দুনিয়ার প্রথম আলোকিত সড়ক’ খ্যাত সড়কটির প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই পাশের সব ভবনই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধারণা করা হয়েছে ওই সড়কের কোনো বাসিন্দাই বেঁচে নেই। সিরিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা ঐতিহাসিক এ শহরটিতে রয়েছে একাধিক সাহাবির কবর, হাজার বছরের পুরোনো মসজিদ, দুর্গ যার কিছুই নেই। এগুলো দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এই স্থাপনা দেখতেই কত মানুষ ভিড় জমাত। আন্তাকিয়ায় একটি ভবনও নেই যেখানে এখন কোনো মানুষ বাস করছেন। সব ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত। কয়েক লাখ মানুষের ঠিকানা তাঁবুর নিচে।
আদিয়ামান প্রদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শহরের মূল এলাকা। এ ছাড়া শহরের বাইরের কোনো কোনো জেলায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর খবরও রয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে শত শত। শহরগুলোর ভেতরকার অবস্থা এখনও ভূতুড়ে। রাতের অন্ধকারে সবসময় আলোর ফোয়ারা চোখে পড়লেও এখন পুরো শহর অন্ধকার। কেননা এসব ভবনে কোনো মানুষ নেই। একাধিকবার শহরের ভেতর প্রদক্ষিণ করে দেখা গেল শত শত ভবনের ধ্বংসস্তূপ মাটির ওপর পড়ে রয়েছে। যেসব ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি সেগুলোর অংশবিশেষ ধসে পড়ছে। ফাটল রয়েছে প্রতিটি ভবনে। আবাসিক কোনো ভবনেই মানুষের দেখা মেলেনি। যারা শহর ছাড়েনি তারা ক্যাম্পে কিংবা ভবনের কাছাকাছি খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে অস্থায়ী আবাস গড়েছেন। এ ছাড়া আফটার শক হচ্ছে প্রতিদিনই। যে কারণে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই তারা তাঁবুতে থাকছেন।
যাদের কয়েকটি বাড়িঘর ছিল তারাও আজ তাঁবুর নিচে। ভাড়াটিয়া, বাড়িওয়ালা পাশাপাশি বাস। একই লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিচ্ছেন। চোখেমুখে লজ্জার ছাপ থাকলেও অসহায়তার দেখা মিলছে। কোনো কোনো ক্যাম্পের তাঁবুতে দেখা মিলছে আগের বিত্তবানদের। তাঁবুর পাশেই রয়েছে ব্র্যান্ডের গাড়ি, জরুরি জিনিসপত্রও। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে টয়লেট, গোসলের জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রতিটি ক্যাম্পেই। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে সেনাবাহিনীও। বিভিন্ন ত্রাণ সহযোগিতাও বণ্টন হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে। তবুও তারা কবে ফিরবেন স্থায়ী ভবনে সে দুশ্চিন্তা।
শহর থেকে দূরের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একই চিত্র। গ্রামে সুউচ্চ ভবন কম থাকায় প্রাণহানি ও ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম। তবে এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। যারা পরিবার হারিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন তাদের কান্না শেষ হচ্ছে না। স্বজনদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। যারাও কিছুটা সুস্থ রয়েছেন তাদের অনেকেই পরিবারের বাকি সদস্যদের অন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আনকারা, ইস্তাম্বুলের মতো বড় বড় শহরের মেয়র, গভর্নর ও সিভিল সোসাইটি তাদের থাকা-খাওয়ার জায়গা করে দিয়েছেন। এসব অঞ্চলের কোনো মানুষই নেই যারা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন হননি। এমন কয়েকটি পরিবার; যারা ধ্বংসস্তূপের নিকট দূরত্বেই তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন। হাতাই প্রদেশের আনতাকিয়ার একটি সড়ক দিয়ে যেতেই আমাদের নজরে আসে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তাঁবুর। গাড়ি থামিয়ে সেখানে যেতেই এক অসহায় মা এগিয়ে এসে কথা বলেন। তিনি ও তার ছোট সন্তানদের বাড়িঘর এখন তাঁবুতেই। কিছু দূরেই তাদের মাটির সঙ্গে পিষ্ট ভবনটি দেখিয়ে বলেন ওটার তৃতীয় তলায় থাকতেন। কীভাবে যে বেরিয়েছেন, সেটা নিজেও বুঝতে পারছেন না। তিনি জানান, তার শিশু সন্তানরা মানসিকভাবে এখন বিপর্যস্ত। তার ভাষ্যমতে, তারা এখন পাগলের মতো দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়ান।
ওই মা আমাদের কাছে জানতে চান, আমরা তাঁবু পরিবর্তন করে কনটেইনার বাড়ি দিব কি না, এজন্যই তার কাছে গেছি কি না। তাকে কিছুটা রান্নার খাবারদাবার দিতে না দিতেই আরও দুটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন দুই বৃদ্ধা। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় গভর্নর, সিটি মেয়র, পৌর মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। উদ্ধার কার্যক্রম এখন আর অব্যাহত না থাকলেও কনক্রিট সরানো, বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা, বাসস্থান, খাবারদাবার, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, মানসিক স্বাস্থ্য এসব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তারা স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্যও কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সরকারের দেওয়া এক বছরের মধ্যে তাদের স্থায়ী নিবাসে ফেরানোর যে ঘোষণা তার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তবে তুরস্কের সাধারণ মানুষের ধারণা, ভূমিকম্পে ক্ষতির পরিমাণ এতটাই বেশি যে এগুলো তৈরি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।
আদিয়ামানের দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নর তুনজার সুনেরের সঙ্গে কথা হলে তিনি ওইদিনকার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন। তিনি জানান, তারা সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জনগণের পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু যে সব মানুষ তাদের পরিবার, জীবন, সম্পদ হারিয়েছেন তার ক্ষতির পরিমাণ কখনো নিরূপণ করা যাবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনিও একটি ক্যাম্পেই তাঁবুতে থাকছেন এবং তাঁবু এরিয়াতে জরুরি সেবাগুলোর কাজ করিয়ে যাচ্ছেন।
এ ছাড়া একটি ক্যাম্পে দেখা হয় আদিয়ামানের সিটি মেয়র সুলেইমান কিলিঞ্চের সঙ্গে। তিনি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তার চারপাশে মানুষের ভিড়। স্বজনহারা, সন্তানহারা সেসব মানুষের জন্য কাজ করতে করতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই এই জনপ্রতিনিধির। কীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদকে পুনরায় গুছিয়ে নেবেন সেই চেষ্টা করছেন। দিনরাত কাজ করতে করতে তার শরীরে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও কোনো বিরাম নিচ্ছেন না।
নাগরিকদের তাঁবু থেকে কীভাবে ভবন নির্মাণের আগ পর্যন্ত কনটেইনারে স্থানান্তরিত করা যায়, সে চেষ্টাই করছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যে কারও হাত নেই তিনি সেটাও উল্লেখ করেন। তুরস্কের ভয়াবহ এ বিপদের সময় বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতার কথাও তিনি স্মরণ করে বলেন, আমাদের উদ্ধার কাজ ত্বরান্বিত করেছে আমাদের বন্ধুদেশ। বাংলাদেশের প্রতি তিনি ধন্যবাদও জ্ঞাপন করেন।
লেখক : তুরস্ক প্রবাসী সাংবাদিক