চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:৫৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোই কি একমাত্র সমাধান

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোই কি একমাত্র সমাধান

বিদ্যুৎ ছাড়া আলো জ্বলে না, পাখা ঘুরে না, কারখানা চলে না। আরও অনেক কিছুই হয় না। আধুনিক মানুষের জীবনের সঙ্গে বিদ্যুৎ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ছাড়া এখন আমাদের একমুহূর্তও চলে না। এ বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের কোনো সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমাতে সরকার বরং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সহজ সমাধানের দিকে ঝুঁকেছে। আর এর মূল্য গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এমন যথেচ্ছাচার কি চলতেই থাকবে?

পনেরো বছর আগে বাংলাদেশে লোডশেডিং ছিল নিয়মিত ঘটনা। তখন দিন-রাতের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকত না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান টার্গেট হয় বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো। যে কোনো মূল্যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানই ছিল প্রথম লক্ষ্য। সরকারও চড়ামূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ। মানুষও খুশি হয়েছে। কিন্তু গত বছর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের মূলবৃদ্ধির জের ধরে আবারও দেশে বিদ্যুৎ সংকট শুরু হয়। নিয়ম করে লোডশেডিং করা হয়। শীত-মৌসুমে চাহিদা কিছুটা কম থাকায় বিদ্যুৎ সমস্যা খুব একটা প্রকট হয়নি। কিন্তু শীত কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সমস্যা ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে। পুরো গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হলে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। দুই মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আগের দুই মাসের ধারাবাহিকতায় চলতি মার্চে টানা তৃতীয় দফায় বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। এতে ক্ষুদ্র শিল্পের গ্রাহকদের জন্য গড় বিদ্যুতের দাম ৯ টাকা ৪১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮৮ পয়সা করা হয়। আর বাণিজ্যিক ও অফিসের জন্য গড় দাম ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১১ টাকা ৯৩ পয়সা। এসব গ্রাহক মূলত নিম্ন চাপের বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। বড় শিল্প-গ্রাহকদের ব্যবহারের পরিমাণ বেশি। মধ্যম চাপের শিল্প-গ্রাহকদের গড় দাম ৯ টাকা ৪৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৭২ পয়সা করা হয়েছে। এর ফলে তাতে বিদ্যুৎনির্ভর শিল্পকারখানায় পণ্যের উৎপাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে। এতে অনেক পণ্যই আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে ভোক্তাদের।

এমনিতেই দেশে ডলার-সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে এখনো সমস্যা হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। গত মাসে গ্যাসের দাম একলাফেই ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কায় পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ আসার হারও তুলনামূলক কম। সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। এভাবে যদি প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। তাদের পণ্য রপ্তানির সক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে। মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এতে আমাদের শিল্পকারখানার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে।

বিপুল ভর্তুকি কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাসে মাসে দর সমন্বয় হতে পারে। দাম বাড়াতে এখন আর গণশুনানির প্রয়োজন হচ্ছে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম।

প্রতিবারই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় উৎপাদন খরচ সমন্বয়ের কথা বলা হয়। পুরো খরচ সমন্বয় করতে হলে বিদ্যুতের দাম হবে আকাশছোঁয়া। তবে কি বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে? বিদ্যুতের ব্যাপারে সরকার আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কথা যতটা শুনছে, দেশের বিশেষজ্ঞদের কথা তেমনভাবে শুনছে না। সরকার ব্যবসায়ীর মতো শুধু লাভক্ষতির হিসাব করছে। দেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় লোকসানি প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন চলছে। সেখানে বিদ্যুতের ওপর বারবার চাপ দিতে হবে কেন? জনস্বার্থে সরকার অনেক কিছুর ওপর ভর্তুকি দেয়। বিদ্যুৎ খাতেও তা দিতে হবে। সরকারের কি জনগণের প্রতি কোনো দায় নেই? জনবান্ধব সরকারকে তো সবার আগে জনগণের কথাই ভাবা দরকার।

দাম না বাড়িয়েও উৎপাদন খরচ সমন্বয়ের আরও অনেক উপায় আছে। বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, সঠিক নীতি গ্রহণ না করা, অপচয়, সিস্টেম লসের নামে দিনের পর দিন চুরি হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে দাম না বাড়িয়েও সরকারের ব্যয় বা ক্ষতি কমানো সম্ভব। ২০০৯ সালে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন যে কোনো মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ ছিল। এ জন্য কিছু ব্যয়বহুল উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিল। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল নানানভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা ছিল। সে চেষ্টা সফলও হয়েছে। কিন্তু ১৪ বছর পর এসেও সেসবের পুনর্মূল্যায়ন হয়নি। বিদ্যুতের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বিদ্যুতের ব্যাপারেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা পরিশোধের আত্মঘাতী অবস্থান থেকেও সরে আসার কোনো চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে না। ভর্তুকির চাপ সামলাতে আমাদের এখন স্বল্প মেয়াদে সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। অপচয় (সিস্টেম লস) আরও কমিয়ে আনার পাশাপাশি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে উৎপাদন ব্যয় কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন যে, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে ভর্তুকির চাপ কমাতে পারত। এ খাতে অপচয় এবং দুর্নীতি কমালেই দাম বাড়াতে হবে না। একইভাবে সরকার যদি দেশে মজুত গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করত তাহলে গ্যাসের দামও বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী না হয়ে দাম বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে। ফলে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়ছে। আর সাধারণ মানুষ যারা ঘরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তারা আরও সংকটে পড়ছেন। বিদ্যুৎ চুরিও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে, পরিবহন (ফ্রেইট) খরচ কমছে, ঠিক তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়? বিদ্যুৎ খাতে উচ্চহারে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বন্ধ করা যায়। এ জন্য দরকার সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা। প্রয়োজনের বাইরে কুইক রেন্টালগুলো ধাপে ধাপে বন্ধ করা গেলেও খরচ অনেক কমে আসবে। সরকার যদি তেলভিত্তিক সেচের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুৎভিত্তিক সেচ চালু করে তাহলেও ব্যয় সাশ্রয় হবে। সরকার এগুলো না করে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করছে।

গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ মিলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মানুষের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ বাড়তি চাপে তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা। আয় বাড়ছে না, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যয়। সরকার তো চট করে দাম বাড়িয়ে তার ব্যয় সমন্বয় করে ফেলে। সাধারণ মানুষ কীভাবে ব্যয় সমন্বয় করবে?

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতোই বিদ্যুৎ মানুষের এখন একটি মৌলিক চাহিদা। এখানে সহনীয় পর্যায়ে ভর্তুকি রাখতে হবে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো সরকারকে দেখতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিনেমা হলের জায়গা বিক্রি, নির্মাণ হবে মাদরাসা

ভারতে লোকসভার ভোট শুরু আজ

পাবনায় চিনিবোঝাই ১২ ট্রাকসহ আটক ২৩

তীব্র গরমে ছয় বিভাগে স্বস্তির খবর

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৯ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ যেসব আমল

শুক্রবার ঢাকার যেসব এলাকায় যাবেন না

ছাত্রলীগ নেতার পা ভেঙে ফেলার হুমকি দিলেন এমপি

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো যে সাহাবির

১০

লোহাগড়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ / কুপিয়ে জখম ৩

১১

চুয়াডাঙ্গায় হিট অ্যালার্ট জারি

১২

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা, সতর্কতা জারি

১৩

পাবলিশহার এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন মিতিয়া ওসমান

১৪

৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্টেন্ট নিয়োগ দিল বিমান

১৫

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের শাড়ি বন্ধুদের দিলেন ব্যারিস্টার সুমন

১৬

‘নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য তুলে ধরার আহ্বান’

১৭

লক্ষ্য যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন  / ৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দিল বিমান

১৮

নওগাঁয় সিআইডি পরিচয়ে চাঁদাবাজি, অতঃপর...

১৯

ইন্দোনেশিয়ায় অগ্ন্যুৎপাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১১ হাজার মানুষকে

২০
*/ ?>
X