বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাস মসৃণ নয়। বাংলা ভাষার ওপর দিয়ে বহু ঝড়-তুফান বয়ে গেছে বিশেষ করে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনার মধ্যদিয়ে। তবে, সব মুসলিম শাসকের ভূমিকা এক ছিল না। কোনও কোনও মুসলিম শাসক আবার বাংলা ভাষার বিকাশে অসাধারণ ভূমিকাও রেখেছেন, যেমন— সুলতানি আমলের শাসকেরা। আবার একই সময় বাংলায় যারা মুসলিম শাসক ছিলেন তারা সবাই ছিলেন মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের লোক। তাদের মাতৃভাষা ছিল আরবি, ফারসি, তুর্কি। যেসব পীর, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ বাংলায় ধর্ম প্রচার করতে এসেছেন তাদের ভাষাও ছিল আরবি, ফারসি। শাসক সম্প্রদায় এবং পীর, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ ও ধর্ম প্রচারকরা বাঙালি মুসলমানের কাছে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইসলাম ধর্মের ন্যায় আরবি, ফারসি ভাষাও ছিল বাঙালি মুসলমানের কাছে পবিত্র। অভিজাত মুসলমানরা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা বলে ঘৃণা করতে থাকেন আর আরবি-ফারসির প্রতি প্রীতি দেখাতে থাকেন। শুরু হয় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ফতোয়া দেওয়া। বাংলাকে হিন্দুর ভাষা, গেঁয়োর ভাষা বলে নিন্দা করা হতে থাকে। নিন্দা ও ফতোয়াকে খণ্ডন করতে অনেক বাঙালি কবি-সাহিত্যিক এগিয়ে আসেন। তাদের অন্যতম ছিলেন কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, কবি সৈয়দ সুলতান, কবি আবদুল হাকিম ও লালন ফকির। আরবি-ফারসি ও নাগরি ভাষা যখন বাংলা ভাষার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন কবি গুরু লালন সাঁইজি এর প্রতিবাদে গাইলেন—
‘বাংলা কেতাব কতই জনা পড়ে
আরবি ফারসি নাগরি বুলি কে বুঝিতে পারে
শিখবি যদি নাগরি বুলি
আগে বাংলা লওগা পাস করে।’ (আবদেল মাননান সম্পাদিত অখণ্ড লালনসঙ্গীত, রোদেলা, ফালগুন ১৪২২, পৃ. ৩০৮)।
আরবি-ফারসি ভিন দেশি ভাষা। সবার পক্ষে ভিনদেশি ভাষা আত্মস্থ করা কঠিন। তখন মুসলমানরা স্থানীয় ভাষার সঙ্গে আরবি-ফারসির সমন্বয় ঘটিয়ে ভারতে নতুন দুটি ভাষার উদ্ভব ঘটান। উত্তর ভারতে উর্দু এবং পূর্ব ভারতে নাগরি ভাষা। উর্দু ছিল হিন্দির বিকল্প এবং নাগরি ছিল বাংলার বিকল্প। আরবি, ফারসি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরি লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভব ঘটে। মধ্যযুগে বিশেষ করে হজরত শাহজালালের সিলেট বিজয়ের পর সিলেট এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জে নাগরি বুলি, নাগরি লিপির প্রচলন এবং প্রভাব বেড়ে যায়। এ লিপির প্রচলন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে লক্ষ করা যায়। সংস্কৃত, বাংলা ভাষা ও লিপিকে মুসলমানরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাষা ও লিপি মনে করত। হজরত শাহজালাল ও তার ৩৬০ অনুসারী বাংলায় আউলিয়া নামে অভিহিত। তারা আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে এক মুসলমানি বাংলা ভাষার প্রচলন করেন, তা সিলেটি নাগরি ভাষা বা নাগরি বুলি, নাগরি লিপি, জালালাবাদি নাগরি, মুসলমানি নাগরি নামে পরিচিত। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকরা বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধর্মীয় বিষয়গুলো চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। আহমদ হাসান দানীর মতে, সিলেটে মুসলমান শাসনের শুরু থেকেই সিলেটি নাগরির ব্যবহার চলে আসছে। এর বর্ণমালা ছিল ৩২টি এবং তা ডান থেকে বাম দিকে পড়তে হতো। মুসলমানরা তাদের নবোদ্ভাবিত সিলেটি নাগরিতে পুস্তক রচনা শুরু করেন। ১৮৬০-৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সিলেটি নাগরি ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে এর প্রসার শুরু হয়। ‘সিলেট ইসলামিয়া ছাপাখানা’ এরূপ প্রথম প্রেস এবং মৌলবি আবদুল করিম টাইপ নির্মাণ ও প্রেস স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। পরে প্রতিষ্ঠিত ‘সিলেট শারদা প্রিন্টিং প্রেস’, কলকাতার ‘শিয়ালদহ হামিদী প্রেস’ ও গার্ডেনার লেনে ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকেও এ লিপিতে পুথিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব এবং সিলেটি নাগরি লেখা নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। সিলেটি নাগরিতে লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূর (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলম (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহ (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ, নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহব্বতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলোর মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। (বাংলা পিডিয়া)।