
একাত্তরের ১৫ মার্চের দিনটিও সভা-শোভাযাত্রা, সরকারি ও আধাসরকারি অফিস-আদালত বর্জনের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। এ ছাড়া আন্দোলনে নিহত বীর শহীদদের উদ্দেশে শোক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কালো পতাকা উত্তোলিত থাকে। এদিন শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ‘সিতারা-ই-খিদমত’, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’, নাটোরের জাতীয় পরিষদ সদস্য শেখ মোবারক হোসেন ‘তমঘা-ই-পাকিস্তান’ ও ফরিদপুর প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশাররফ হোসেন ‘তমঘা-ই-কয়েমে আজম’ পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব বর্জনের ঘোষণা দেন। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় করাচি থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আজকের দিনে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান তাকে স্বাগত জানান। কোনো সাংবাদিক ও বাঙালিকে এ সময় বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। দ্রুত তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে গমন করেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রামের একটি মিছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবস্থানের পর প্রেসিডেন্ট হাউসের সম্মুখে প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বিভিন্ন প্রকার স্লোগান দিতে থাকে। আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হলে এদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে ইস্তফা দেন। চিকিৎসকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত চিকিৎসকদের এক সভা থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দাবি উত্থাপন করে বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে।
ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান বলেন, জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন তার পিপলস পার্টি এ অঞ্চলে শতকরা আটত্রিশ ভাগ ভোটও পায়নি। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দুটি নয়; একটিই এবং তা হলো আওয়ামী লীগ। রাতে ঢাকায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের এ আহ্বানে জনগণের নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে। তোপখানা রোডে বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নারী সমাবেশ থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সব কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এদিন চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের বিশাল সমাবেশ। অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। একই দিন ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরেও সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং চলতে থাকে। নেত্রকোনায় সুইপার ও ঝাড়ুদাররা ঝাড়ু, দা, লাঠি ও কোদাল নিয়ে মিছিল বের করে। বগুড়া, খুলনা, রংপুর, লাকসাম, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার সপক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়।