
বায়ান্নের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাড়াও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে আরও দুটি আন্দোলন হয়েছে। এর একটি আসামে, অন্যটি মানভূমে। ভারত ভাগের সময় আসামে প্রায় ২০ লাখ বাঙালির বসবাস ছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালের জনগণনায় বাঙালির সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। এরপর শিক্ষা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিরা বঞ্চিত হতে থাকেন। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসাম সরকারের পুলিশ সত্যগ্রহীদের ওপর গুলি করে। পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহীদ হন। এর ফলে শেষ পর্যন্ত আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং আসামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাতৃভাষার অধিকার।
তবে ভারতে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন প্রথম হয় মানভূম জেলায়। বায়ান্নের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বরাক উপত্যকার আন্দোলনের চেয়ে মানভূমের আন্দোলন বিস্তৃতির দিক থেকে কম। এই আন্দোলন শুধু মানভূম জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯১২ সালে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে বাংলা ভাষী প্রধান মানভূম জেলাকে বাংলা থেকে বিহার ও ওডিশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও মানভূম জেলা বিহার ও ওডিশার মধ্যেই থেকে যায়। এরই প্রতিবাদে পুরুলিয়ার বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, কয়লা খনি মালিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার দাবিপত্র পেশ করে এবং আন্দোলন শুরু হয়। বাংলা ভাষী মানুষের অধিকার রক্ষার এই আন্দোলন দুটি পর্যায়ে হয়েছিল। একটি স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত এবং অন্যটি স্বাধীনতা-পরবর্তী ভাষা আন্দোলন। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলনের চেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে ১৯৩৫ সালের পর বিহার প্রদেশের সরকার বিহারি সমিতির মাধ্যমে মানভূমে হিন্দি ভাষার প্রচার শুরু করে। তখন এর বিরুদ্ধে বাঙালি সমিতি বাংলা ভাষার প্রচার চালায়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বিহার সরকার মানভূম জেলাকে বাংলা ভাষীর পরিবর্তে হিন্দি ভাষী জেলায় পরিণত করার জন্য ব্যাপক হিন্দিকরণ নীতি অনুসরণ করে। শেষ পর্যন্ত মানভূম জেলা কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা দলত্যাগ করে এবং ১৯৪৮ সালে লোকসেবক সংঘ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। এই লোকসেবক সংঘের নেতৃত্বেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়। নেতৃত্ব দেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, অরুণচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা দেবী, ভজহরি মাহাতো, ভীমচন্দ্র মাহাতো প্রমুখ।
১৯৪৮ সাল থেকে কয়েকটি পর্যায়ে মানভূমের ভাষা আন্দোলন হয়। যথা–ভাষা সত্যাগ্রহ, বিধানসভা ও লোকসভায় সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আন্দোলন, টুয়ু সত্যাগ্রহ, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বঙ্গভঙ্গ সত্যাগ্রহ অভিযান। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলনে কৃষক, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। একপর্যায়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে মানভূম জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয় এবং পুরুলিয়া সদর মহকুমায় ১৬টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া নামে নতুন একটি জেলা তৈরি হয়। এই জেলা ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু মানভূম জেলার শিল্পসমৃদ্ধ ধানবাদ মহকুমাসহ বাকি বাংলা ভাষী অঞ্চলগুলোকে বিহার রাজ্যের মধ্যেই রেখে দেওয়া হয়। ফলে মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলন আংশিক সফল হয়েছিল।
লেখক : সাংবাদিক