জাফর ওয়াজেদ
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২২, ১১:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জরুরি

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জরুরি

নতুন প্রজন্ম অবহিত নয়, গণহত্যার সেই দুঃসহ রাত সম্পর্কে। তাই সেদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে সরকারের উচিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। এটা তো বাস্তব যে, একাত্তরে যে গণহত্যা এ দেশে সংঘটিত হয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় অবশ্যই জরুরি। একই সঙ্গে গণহত্যার সাক্ষী যারা, তাদের বিবরণ তুলে ধরা। বীরের জাতির জন্য এ পদক্ষেপ সংগত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

নারী, শিশু, পুরুষ-নির্বিশেষে ঘরে ঘরে ঢুকে বিহারিরা বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। যেমন জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় চড়াও হয়ে গায়ক সাদী মোহাম্মদের পিতা মোহাম্মদ সলিমুল্লাহকে আরও কয়েকজন বাঙালিসহ হত্যা করেছিল। মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই গণহত্যার শিকার হয়েছেন। খুব কমজনই বাঁচতে পেরেছিলেন। যারা বেঁচেছিলেন, তারা স্বাধীনতার পর সেই দুঃসহ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন সংবাদপত্রের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর আজহার আলী ২৫ মার্চ রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের ১৪/এইচ ফ্ল্যাটে সপরিবারে থাকতেন। রাত ১২টার পর চারদিক থেকে অকস্মাৎ বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলিবর্ষণের বিভীষিকাময় শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভোরে পাঞ্জাবি সেনারা ১১ ও ১২ নম্বর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তার ফ্ল্যাটের নিচতলায় থাকত ডা. মুর্তজা। তাকেসহ আরও তিনজনকে ১২ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে লাশ তুলে বাইরে রাখার নির্দেশ দেয় সেনারা। ডা. মোকতাদিরসহ আরও অনেক ছাত্রের লাশ বের করেন তারা। এরপর সেনারা ১১ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢুকে ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে। ২৭ মার্চ পর্যন্ত লাশটি পড়েছিল। সেনারা আজহারের বাসায় ঢুকতে গিয়েও ফিরে যায় বলে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুবেদার খলিলুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে মিলব্যারাক পুলিশ লাইনে কর্তব্যরত থাকায় বেঁচে যান। ২৯ মার্চ তাকে কোতোয়ালি থানায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখতে পান দেয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত। গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে দেয়াল। বুড়িগঙ্গার পাড়ে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ দেখেন, কনস্টেবল আবু তাহেরের (নম্বর ৭৯৮) পোশাক পরা লাশ ভাসছে। আরও বহু সিপাহির ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান। আরও দেখেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর অসংখ্য লাশ। বাদামতলী ঘাট থেকে শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অসংখ্য মানুষের বীভৎস পচা ও বিকৃত লাশ; অনেক উলঙ্গ নারীর লাশ দেখেন। এই পূতপবিত্র দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ করে গুলিতে ঝাঁজরা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। দেখেন তিনি প্রতিটি লাশে বেয়নেট ও ব্যাটনের আঘাত। কারও মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আছে। পাকস্থলী সমেত হৃৎপিণ্ড বের করা হয়েছে, পায়ের গিঁট; হাতের কবজি ভাঙা, ফুলছে পানিতে। সুবেদার খলিলুর রহমান ১৯৭৪ সালে ২ জুন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানের যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, তা হানাদারদের নৃশংসতার এক দলিল বলা যায়। দেখেছেন তিনি পুরান ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় লাশ আর লাশ এবং বিহারিদের উল্লাস ও উন্মত্ত লাফঝাঁপ। হানাদারদের নির্বিচারে বাঙালি হত্যার খুশিতে বিহারিরা রাস্তায় পড়ে থাকা নিরীহ বাঙালিদের লাশের ওপর লাথি মারছে, কেউ প্রস্রাব করছে। সরু বাঁশের মাথায় বাঙালি বালক ও শিশুর লাশ বিদ্ধ করে খাঁড়া করে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ লাশগুলো দা দিয়ে কুপিয়ে কুচি কুচি করে কেটে আনন্দ করছে। রাস্তার দুই পাশের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট শেষে বিহারিরা ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঠাঁটারীবাজারে বাঙালি তরুণের বীভৎস লাশের ওপর পেট চিরে বাঁশের লাঠি খাঁড়া করে লাঠির মাথায় স্বাধীন বাংলার একটি মলিন পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর বিহারিরা উল্লাস করছে। রমনা থানার সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন মতিউর রহমান, ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে করতে থানায় ঢুকে পড়ে। বাঙালি পুলিশও পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সারারাত হানাদারদের প্রতিরোধ করতে পারলেও ভোরে থানার কলোনি ঘেরাও করে কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দি করে। লাথি মারতে মারতে থানার পশ্চিম দিকের মাঠে নিয়ে গিয়ে ‘নজর নিচে দে কর মিট্টি মে শো যাও’ বলে উপুড় করে লাথি মেরে শুইয়ে দেয়। টানা তিন ঘণ্টা এলোপাতাড়ি পেটানো হয় তাদের। আর অকথ্য গালাগালি করতে থাকে এই বলে যে, ‘শালা মালাউন, শোয়ার কা বাচ্চা, আভি জয় বাংলা বলতা নেহি। শালা কাফের, হিন্দুকা লাড়কা, তোমহারা মুজিবর বাবা আভি কাহা হায়?’ পিটুনির চোটে অনেকে জ্ঞান হারায়, কারও হাত-পা ভেঙে যায়।

একাত্তরের পঁচিশ মার্চ থেকে যে গণহত্যা শুরু হয়, তা ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সেসব হত্যাযজ্ঞের বিবরণ লিখে লিখে শেষ করা যাবে না। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ধরন সভ্যতাবিবর্জিত মানুষের নির্মমতা এবং নৃশংসতার চেয়েও জঘন্য ছিল। তাদের নির্যাতনের রূপ নির্যাতিতদের কাছ থেকে যা পাওয়া গেছে, তা বীভৎস ও ভয়াবহতারই নামান্তর। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করত। শক্তসমর্থ, তরুণ ও যুবকদের রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্দি করে এনে চোখ বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর শারীরিক নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনো এককভাবে, কখনো কয়েকজনকে একসঙ্গে গুলি করে নদী, জলাশয় বা গর্তে ফেলে দিত। কখনো সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করত। কখনো নিকটজনের সামনেই বন্দিদের এক এক করে জবাই এবং দেহ টুকরো টুকরো করা হতো। প্রকাশ্য বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করত। চোখ উপড়ে ফেলত। উলঙ্গ অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলত। বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা বা বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দিত। বাঁশ এবং রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চেপে ধরে থেঁতলে দিত। বেয়নেট ও ধারাল অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে, কখনো পেটের সব নাড়িভুঁড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলত। দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারত। বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা ছিল মামুলি ব্যাপার। মলদ্বার ও আশপাশের স্থানে বরফ ও উত্তপ্ত লোহা ঢোকানো হতো। গায়ে ও মলদ্বারে বৈদ্যুতিক শক প্রদান, আঙুলে সুচ ফোটানো, নখ ও চোখ উপড়ে ফেলা, যৌনাঙ্গে লাঠি, রাইফেলের নল, ধারাল বোতল জাতীয় জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। অণ্ডকোষ থেঁতলে মৃত্যু যন্ত্রণা প্রদান, বাঁশডলা, বরফের চাঙরে ওপর রেখে পেটানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া ইত্যাদি অজস্র পদ্ধতি ছিল নির্যাতনের।

একাত্তরে বাংলাদেশে বিশ্ব ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা ঘটিয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। শুধু বাঙালি হয়ে জন্মানোর দায়ে পাকিস্তানি হানাদাররা নৃশংস গণহত্যার যে দৃষ্টান্ত এ দেশে রেখে গেছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। অত্যাচারের যেসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া তারা উদ্ভাবন করেছিল, তার মধ্যে গুলিতে হত্যা করাই ছিল সবচেয়ে শান্তির মরণ। তাদের অপকর্ম চাপা দেওয়ার জন্য একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানিরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকট’ শিরোনামে। হাজার পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ, নির্বাচন, ভারত সম্পর্কে পাকিস্তানি জান্তা শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মিথ্যাচার বিধৃত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ দিনগত রাতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অভ্যুত্থান বাস্তবায়িত করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। পুরো শ্বেতপত্রে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসত্য, কল্পিত বিষয়াদি তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর হলেও গৃহীত এ সিদ্ধান্ত বাঙালিকে আরও আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম অবহিত নয়, গণহত্যার সেই দুঃসহ রাত সম্পর্কে। তাই সেদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে সরকারের উচিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। এটা তো বাস্তব যে, একাত্তরে যে গণহত্যা এ দেশে সংঘটিত হয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় অবশ্যই জরুরি। একই সঙ্গে গণহত্যার সাক্ষী যারা, তাদের বিবরণ তুলে ধরা। বীরের জাতির জন্য এ পদক্ষেপ সংগত।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফেরত পাঠানো হলো মিয়ানমারের ২৮৮ সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্যকে

অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার পদে ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভালো কিছুর সম্ভাবনা দেখছেন সাকিব

মেট্রোরেল সাভার পর্যন্ত সম্প্রসারণের দাবিতে মানববন্ধন

গরুর দুধে প্রাণঘাতী ভাইরাস শনাক্ত, আক্রান্ত এক ব্যক্তি

সমুদ্র সৈকতে ভয়ংকর বিষধর সাপ, আতঙ্ক

রাজধানীর যে ২০ স্থানে বসছে পশুর হাট

শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন আইন

‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্কলার্স কাপ ২০২৪’ / শুরু হলো জমজমাট বুদ্ধির লড়াই!

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি, পদসংখ্যা ৫৪

১০

‘সবসময় স্বপ্ন ছিল চেন্নাইয়ের হয়ে খেলার’

১১

কুবিতে উপাচার্য, ট্রেজারার ও প্রক্টরের কার্যালয়ে তালা

১২

ভিত্তিহীন মেইলে সমর্থন প্রত্যাহার / মামলায় জিতলেন লেবার পার্টির প্রার্থী নুরুল খান

১৩

চবির হলে ছাত্রলীগ কর্মীর মদপান, ছবি ভাইরাল

১৪

কুড়িগ্রামে হিটস্ট্রোকে এক নারীর মৃত্যু

১৫

গাজীপুরে বিদ্যুতের সাবস্টেশনের ট্রান্সফরমারে আগুন

১৬

বেলুন উড়িয়ে শুরু হলো জব্বারের বলী খেলা

১৭

২৮ এপ্রিল খুলছে স্কুল-কলেজ

১৮

নারী শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে : জিল্লুর রহমান

১৯

জিআই সনদ পেল টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্য

২০
*/ ?>
X