শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১২ মে ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শুরু হয়েছে হজের প্রস্তুতি মৌসুম

শুরু হয়েছে হজের প্রস্তুতি মৌসুম

পবিত্র হজ পালনের মৌসুম হিসেবে মহান আল্লাহ তিনটি মাসকে নির্ধারণ করেছেন, যথা—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এজন্য এই মাসগুলোকে ‘আশহুরুল হজ’ তথা ‘হজের মাসসমূহ’ বলা হয়। অবশ্য হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় মাত্র এক দিনে। চাঁদের হিসাবে প্রতিবছর জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ সময়ের মধ্যে হজের কার্যক্রম আদায় করতে হয়। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি বছরের ২৭ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ থেকে এবার হজফ্লাইট শুরু হবে ২১ মে। এ বছর হজে যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত নিবন্ধন করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৪৯১ বাংলাদেশি। এ হজব্রত পালনের জন্য প্রতিটি মুসলমান উদগ্রীব থাকে এবং সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে মক্কার তীর্থভূমিতে ভ্রমণ করেন। উদ্দেশ্য, করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে খালি হাতে যায়, আবার খালি হাতেই ফিরে আসে। প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছুই পড়ে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হজের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাওয়া। তাই আল্লাহ যাদের বায়তুল্লাহ হজের জন্য কবুল করেছেন তাদের কর্তব্য সফরে রওনা হওয়ার আগেই হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।

হজের সফরে যারা যাচ্ছেন, তাদের বেশ কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। মানসিক ও শারীরিক দুই প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। কারণ ইসলামের কিছু বিধান শারীরিক, কিছু আর্থিক আর কিছু শারীরিক ও আর্থিক উভয়টির সমন্বয়ে। নামাজ ও রোজা শুধু শারীরিক ইবাদত, জাকাত আর্থিক ইবাদত আর হজ হলো শারীরিক এবং আর্থিকের সমন্বিত ইবাদত। ইসলামের এ বিধান পালনের জন্য বান্দাকে যেমন অর্থ খরচ করতে হয়, তেমনি শারীরিক অনেক পরিশ্রমও করার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে হজের মূল দিনগুলোয় অর্থাৎ ওমরার তাওয়াফ, সাঈ, মিনা, জামারায় পাথর মারা, মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়। চাইলে যখন-তখন যানবাহন পাওয়া যায় না। থাকা-খাওয়ার জন্যও বহু সমস্যা ও পেরেশানির মুখোমুখি হতে হয়। ইহরাম বাঁধার পর আর মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না এবং অভ্যস্ত ও নিয়মিত ক্রিয়াকলাপও সম্পাদন করা যায় না। বরং বহু অভ্যস্ত বিষয় পরিহার করে অনভ্যস্ত বিষয় পালন করতে হয় এবং নতুন নতুন কাজের মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি হজ পালনকারী এতদিন নিজ এলাকায় নিয়মিত যেসব ইবাদত করেছেন তার মধ্যেও পরিবর্তন দেখা যায়। সারা জীবন জোহর-আসর, মাগরিব-এশা নির্দিষ্ট সময়েই আদায় করেছেন; কিন্তু হজে এসে জোহর-আসরকে জোহরের সময় এবং মাগরিব-এশাকে এশার সময় আদায় করতে হয়। তাই হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সুস্থ-সবল শরীরে গন্তব্যে রওনা হতে হবে।

হজ যেমন একটি শারীরিক ইবাদত তেমনি একটি অর্থনৈতিক ইবাদতও। কষ্ট, ক্লেশ ও শ্রম ব্যয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর টাকা-পয়সারও প্রয়োজন হয়। তাই হজের সফরে রওনা হওয়ার আগে অর্থনৈতিক প্রস্তুতিও পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হয় এবং হজ পালনের যাবতীয় ব্যয় হালাল ও বৈধ উৎস থেকে বহন করতে হয়। কেননা ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা কবুলের জন্য হালাল, পবিত্র ও অনুমোদিত রিজিক হওয়া অন্যতম প্রধান শর্ত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে লোকসকল! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র‌। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। সব রাসুলকে তিনি যে আদেশ দিয়েছেন মুমিনদেরও সেই আদেশ দিয়েছেন।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! আপনারা উত্তম ও পবিত্র রিজিক আহার করুন এবং সৎকর্ম করুন। আপনারা যেসব আমল করেন আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (সুরা মুমিনুন : ৫১)। আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা হালাল ও উত্তম রিজিক আহার করো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। অতঃপর নবীজি এলোকেশী ও ধুলোমলিন হয়ে দীর্ঘ সফরকারী এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যাকে আসতে দেখে হাত প্রসারিত করে হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! বলতে থাকে। অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম এবং হারাম বস্তু দ্বারায় প্রতিপালিত। তো এসবের পর কীভাবে তার দোয়া কবুল করা হবে! (মুসলিম : ১০১৫)।

ইসলামে হজের ইবাদত মূলত আধ্যাত্মিক প্রেমের অবগাহন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার আবেগ ও ভক্তির মহামিলন। শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরে সমস্বরে তালবিয়া ধ্বনি, কাবার চারপাশে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান, জমারায় রমি, মিনায় কোরবানি—মহান স্রষ্টার প্রতি নগণ্য সৃষ্টির প্রেম নিবেদনমূলক এসব কীর্তি একজন মানুষ নিবিষ্টচিত্তে তখনই আদায় করতে পারে; যখন দুনিয়ার সব ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশে রওনা হবে। তাই দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাগ্রচিত্ত নিয়ে হজব্রত পালন করতে যেতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা ও কাজকর্ম থেকে ফারাগ হয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার উৎসাহ এসেছে হাদিসে কুদসিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব। যদি তা না করো তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব আবার অভাবও দূর করব না।’ (তিরমিজি : ২৪৬৬)।

হজের সফর যেহেতু পবিত্র সফর, তাই সফরসঙ্গী যেন হয় পুণ্যবান। কারণ হজে যেমন অতি সহজে আল্লাহর সান্নিধ্য, পুণ্য ও পুরস্কার লাভ করা যায়; তেমনি অসৎ সঙ্গী-সাথীদের পাল্লায় পড়ার কারণে ক্ষতিরও কারণ হয়। অনেককে দেখা যায়, হজ করে এসে আগের চেয়ে খারাপ জীবনযাপন করে, মন্দ ও অসৎ পথে চলে, ধোঁকা ও প্রতারণার বাজার সরগরম রাখে। যেন হজের মাধ্যমে এসবেরই প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে সে। এটা তার হজ কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই হজ বের হওয়ার আগে মুত্তাকি, পরহেজগার ও ভালো মানুষ নির্বাচন করতে হবে এবং তাদের পুণ্যসান্নিধ্যে হজপালনের চেষ্টা করতে হবে। একজন মুত্তাকি সাথী খুঁজে পাওয়া তেমন কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজেই ভালো সাথী মিলে যেতে পারে। আর পাঁচ-সাতজন ভালো মানুষের সঙ্গে হজ করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। রাসুল (সা.) ভালো-মন্দ সঙ্গীর উপকার ও অপকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সৎ ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হলো, আতর বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরের মতো। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু কিনবে অথবা তার কাছ থেকে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাঁপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি : ৫৫৩৪)।

হজ ফরজ হওয়ার অত্যতম শর্ত হচ্ছে সফরকালে পরিবারের খাদ্যবস্ত্রের ব্যবস্থা করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। তাই সফরের এক-দেড় মাস সময়ে পরিবারের সদস্যরা কোথা থেকে প্রয়োজন মিটাবে তার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনা ও অর্থের জোগান দিয়ে যেতে হবে। যাতে গৃহকর্তার অবর্তমানে পরিবারস্থ কেউ সংকট-সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কেউ যদি কোনো টাকা পায় তাহলে যথাসম্ভব আদায় করে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব না হলে সময় চেয়ে নিতে হবে এবং এ ধরনের ঋণের কথা পরিবারের লোকজনের কাছে বলে যেতে হবে। কেননা জীবন-মৃত্যুর সময়সন্ধিক্ষণ অনিশ্চিত। যে কোনো সময় যে কারও মৃত্যুর যবনিকাপাত ঘটতে পারে। একইভাবে যদি বোনের অংশ না দেওয়া হয়ে থাকে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় যদি কারও হক নষ্ট করা হয়ে থাকে, তাহলে হজের আগে অবশ্যই তার সমাধান করে যেতে হবে। মানুষের হক মেরে, অধিকার খর্ব করে হজের প্রকৃত প্রাপ্তি ও সুফল লাভ করা সম্ভাব হবে না।

আল্লাহতায়ালা দান-সদকা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা তোমাদের দান-অনুদান অনুগ্রহ ফলানো ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে বরবাদ করো না ওই লোকের ন্যায়, যে তার ধন সম্পর্কে লৌকিকতার উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। মহান আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন।

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১০

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১১

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১২

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৩

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৪

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৫

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৬

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৭

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

১৮

৭৩ বছরে ছাত্র ইউনিয়ন  

১৯

কৃষক খুনের ঘটনায় থামছে না ভাঙচুর ও লুটপাট

২০
*/ ?>
X