২৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ-কার্ডের বিষয় ও বক্তব্য নিয়ে দেশে তোলপাড় চলছে। পক্ষে-বিপক্ষে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক। সংবাদ-কার্ডটিতে লেখা ছিল : ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস এবং চালের স্বাধীনতা লাগব।’ জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে একটি সাত বছরের শিশু এ কথাগুলো বলেছে বলে ওই পত্রিকার সাভার প্রতিনিধির খবরে লেখা হয়। পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছবি আর প্রকাশিত উদ্ধৃতির ব্যক্তিরা ছিলেন আলাদা। তবে বক্তব্য ঠিক। অর্থাৎ শিশুর মুখ দিয়ে যে কথা বলানো হয়েছে তা শিশুটি বলেনি, বলেছেন একজন দিনমজুর।
ওই পত্রিকাটি এর আগে একাধিকবার ‘উদ্দেশ্যমূলক’ খবর প্রকাশ করে সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এবার স্বাধীনতা দিবসেও পত্রিকাটি সৎ সাংবাদিকতার কারণে নয়, স্বাধীনতাকে উপহাস বা বিদ্রুপ করার উদ্দেশ্য নিয়েই ওই বক্তব্য প্রচার করেছে।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সময় সে দুর্ভিক্ষকে যাতে সরকার মোকাবিলা না করতে পারে, তার জন্য বিদেশি ষড়যন্ত্র, খাদ্যবাহী জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে বাংলাদেশে আসতে না দেওয়ার কাহিনি প্রসঙ্গত মনে পড়ছে। সে সময়ে যে ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হয়, আক্ষরিক অর্থে সেই ষড়যন্ত্রের ছেঁড়া ‘জাল’ পরিয়ে রংপুরের চিলমারী বন্দরের বাসিন্দা আজন্ম বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী কিশোরী বাসন্তীর ছবি তোলা হয়, বিনিময়ে তার হাতে দেওয়া হয় একটি নোট। ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক ছবি তোলেন এবং সে পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। পুরো বিশ্বে সে ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার ভীষণ বিব্রত হয়। অথচ লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড়ের অভাবে মাছ ধরার জাল পরে থাকার ছবিটি ছিল সাজানো।
আর সে ঘটনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর স্বাধীনতার ৫২ বার্ষিকীতে দেশের একটি বিখ্যাত জাতীয় পত্রিকায় একজন শিশুর মুখ দিয়ে বলানো হলো—‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’। রীতিমতো জ্ঞানগর্ভ কথা। এমন দার্শনিক মন্তব্য নিয়ে চাঞ্চল্য না হয়ে পারে? হয়েছেও তাই।
অনেকের মতো আমিও মনে করি, এ ধরনের বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে আমাদের মহান স্বাধীনতা এবং ৫১ বছরে আমাদের অর্জনকে উপহাস ও কটাক্ষ করা হয়েছে। যদিও যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে চরম অপমান করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, ১৯৭৭ সালে দুজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ফালান্ড ও পারকিনসন তাদের বই ‘Bangladesh : Test Case of Development’-এ বলেন যে, বাংলাদেশ যদি উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সফল হয় তাহলে বুঝতে হবে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে উন্নয়ন সম্ভব, সে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের মডেল বলে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং তার সিংহভাগ কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের। এটা এখন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। এ কথা স্বীকার্য, করোনা-পরবর্তী ও তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতসৃষ্ট বহিরাগত সমস্যায় অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা সমস্যায় পড়লেও অনেক দেশের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনায় তো অনেক অনেক ভালো। তবে দেশে নানা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ও সে ক্ষেত্রে সরকারের দৃশ্যমান অসহায়তায় কিংবা নিশ্চেষ্টতায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এ ছাড়া দেশে আয় বৈষম্য সাংঘাতিক বেড়েছে। বৈষম্যের এ ধারাটি গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষদিকে জিয়াউর রহমানের আমল থেকে ক্রমাগত মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের ফল। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও দাতা দেশগুলোর চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বাংলাদেশের ছিল না। আমরা ভুলে যাইনি যে, এরশাদ আমলে বহু বছর বাজেটের পুরোটাই বিদেশি সাহায্যনির্ভর ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারতীয় অর্থনীতি মহাসংকটে পড়েছিল। লেনদেনের ভারসাম্যে বিরাট ঘাটতি দূর করতে স্বাধীনতার পর সেই প্রথম মজুত সোনা ভারত রপ্তানি করে ঘাটতি মেটায়। দীর্ঘদিন ভারত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপ সহ্য করে নিজস্ব নীতি অবলম্বন করেছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে তাদের দ্বারস্থ হয়। স্বাভাবিকভাবে দুটি সংস্থা তাদের শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিতে রাজি হয়। সম্ভবত সিপিআইয়ের এক নেতা বিবৃতি দিয়ে বলেন যে পরবর্তী বাজেটে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের এই শর্তের প্রতিফলন দেখা যাবে। অর্থমন্ত্রী সেটা প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করলেও বাজেট ঘোষিত হলে দেখা যায়, সিপিআই নেতার কথা সম্পূর্ণ সঠিক। মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি তথা বিশ্বায়নের ইতিবাচক নেতিবাচক ফলাফলের অন্যতম নেতিবাচক ফল হলো আয় বৈষম্যের তীব্র বৃদ্ধি এবং তা সব দেশে। পার্শ্ববর্তী ভারত বলুন, চীন বলুন—একই চিত্র। তাই বলে স্বাধীনতার অর্জনকে এভাবে হেয়প্রতিপন্নের উদ্দেশ্যে সংবাদ তৈরির স্বাধীনতা কোনো দেশের সংবাদপত্র ভোগ করে না।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস, কৃষিশিল্প খাতে অর্জন, নারীদের ক্ষমতায়ন, সাধারণ ও নারীশিক্ষা প্রভৃতিতে অর্জন সম্পর্কে অনেক ভালো বস্তুনিষ্ঠ গবেষণামূলক প্রবন্ধ, বইও বেরিয়েছে। তেমন একটি বই ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী ও নিয়াজ মুজেরী প্রণীত পলগ্রেভ ম্যাকমিলান প্রকাশিত ‘Bangladesh at Fifty : Moving Beyond Development Traps’.
এ অবস্থায় ওই দৈনিক পত্রিকাটি একজন শিশু কিংবা দিনমজুরকে উদ্ধৃত করে স্বাধীনতা দিবসের দিনই অমন একটি ‘সেনসশনাল’ রিপোর্ট প্রকাশকে সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মানতে আমার তো কষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এটা আমার জানা যে, ঔপনিবেশিক নাগপাশ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদাহরণ এ উপমহাদেশে আছে। আমার জানা সে উদাহরণগুলো অবশ্য কোনো প্রকার ষড়যন্ত্রের অংশ নয়। আমাদের জাতীয় কবির ক্ষেত্রে তা হতাশা ও প্রচণ্ড ক্ষোভ, দুঃখ, আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত। ‘আমার কৈফিয়ৎ’—এ দীর্ঘ বিখ্যাত কবিতায় এক জায়গায় বিদ্রোহী কবি বলছেন ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন’। ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে এবং দুটি ভাত, একটু নুন দিতেই স্বরাজের সেই সংগ্রাম এবং কবি ভালোভাবেই জানতেন যারা স্বরাজের জন্য সংগ্রাম করছেন, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় জনগণের ভাত, নুন নিশ্চিত করার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না, না অর্থনৈতিক, না প্রশাসনিক, না রাজনৈতিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে যে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে দুর্ভিক্ষ হয়, বাসন্তীকে ছেঁড়া জাল পরিয়ে ইত্তেফাক ছবি প্রকাশ করে এবং কেউ নিজের বমি খাচ্ছে তেমন ভান করা একটি ছবি দেখে এবং সেসব ছবিকে প্রকৃত ঘটনা বলে বিশ্বাস করে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে রেগে গিয়ে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’। কবিতাটি শেষ হয় এমনিভাবে ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’। রফিক আজাদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ। বেশ ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিল কবিতাটি নিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কবিকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ভারতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-সিপিআইয়ের কংগ্রেসে পার্টি সেক্রেটারি পি সি যোশির স্থলাভিষিক্ত হন চরমপন্থি বি টি রণদিভে। ভুল পার্টি লাইনে তখনই বিপ্লবের তাড়নায় স্লোগান ধরলেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির ওপর শাসকদের চরম নিপীড়ন নেমে এসেছিল। যদিও তা কোনো চক্রান্তের অংশ ছিল না, সিপিআই পরে তাদের ভুল উপলব্ধি করেছিল।
১৯৭৪ সালে বাসন্তীকে জাল পরানোর চক্রান্তের মোটিভ পরে পরিস্ফুট হয়। ২০২৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করার মোটিভও নিশ্চয়ই জানা যাবে একসময়।
বাংলাদেশের ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’ বা ভাবমূর্তি বেড়েছে বলে একটি বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদনে যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তা অবশ্য ওই দৈনিকের কাছে প্রকাশযোগ্য খবর বলে মনে হয়নি। এ থেকেও পত্রিকাটির ‘মতলব’ বোঝা যায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যান্ড ফিন্যান্স’ প্রকাশিত ‘নেশন ব্র্যান্ডস ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশের ইমেজ বা ভাবমূর্তি নির্ণয় করে। বিষয়গুলো হলো—পণ্য ও পরিষেবার মান, বিনিয়োগ এবং সমাজ। এগুলো আবার পর্যটন, বাজার, সুশাসন এবং জনগণ ও দক্ষতা—এ চারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ নির্ভর করে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। বিশ্ববাজারে এটি একটি বড় সম্পদ। ইমেজ ভালো থাকলে বিনিয়োগ বাড়ে, রপ্তানিতে গতি সঞ্চার হয় এবং পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশের ইমেজ সবচেয়ে বেড়েছে। ২০২২ সালের ৩৬তম থেকে চলতি বছর বাংলাদেশ উঠে এসেছে ৩১তম অবস্থান। সেই হিসাবে বাংলাদেশের পাঁচ ধাপ উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের এই ব্র্যান্ড ইমেজের আর্থিক মূল্য ৫০ হাজার ৮০০ কোটি (৫০৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি ৫৩ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে ছিল ৩৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার (৩৭১ বিলিয়ন ডলার) ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্র্যান্ড মূল্য বেড়েছে ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অতি সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিতে সাউথ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জো উইলসন একটি বিল উত্থাপন করেছেন, যেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়েছে। এসব থেকে এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়নি।
সংবাদপত্র নিশ্চয়ই সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে, কিন্তু স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ করা কি শোভন বলে মানা যায়? দেশের মধ্যে যখন স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি আছে, তখন এমন খবর কোন পক্ষকে উৎসাহিত করার জন্য?
লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর