
আজ ১৪ মার্চ, আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস। আরেকভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু; এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিবসটি উপলক্ষে নদী, জলাভূমি ও পানিসম্পদবিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব শেখ রোকনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সঞ্জয় হালদার
কালবেলা : যমুনা নদী ছোট করার প্রকল্প বিষয়ে আপনার মতামত কী?
শেখ রোকন : আমার মতামত খুবই পরিষ্কার, প্রকল্পটি অবাস্তব। কোনো বিবেচনাতেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়, অর্থের শ্রাদ্ধ করে বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও টেকসই হবে না। শুধু আমি নই, যমুনা নদী সম্পর্কে যাদের কাণ্ডজ্ঞান আছে, তারা এটা সমর্থন করবেন না। যমুনা নদী সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে কেউ এমন অবাস্তব প্রকল্প নেওয়ার কথা নয়। আপনি খেয়াল করবেন, বিশেষজ্ঞ মত দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষক ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি হয়তো ছুড়ে ফেলে দেবেন। আমারও একই মত।
কালবেলা : প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় কেন, আরও ব্যাখ্যা করবেন?
শেখ রোকন : দেখুন, কাঠামো ও প্রবাহের দিক থেকে যমুনা সম্ভবত বিশ্বের অস্থিরতম নদী। আপনি জানেন, কারণ প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার গতিপথের প্রায় পুরোটাই এই নদী এসেছে তিব্বত, অরুণাচল ও আসামের পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যথাক্রমে সাংপো, সিয়াং, বুঢ়া লুইত ও ব্রহ্মপুত্র নামে। তারপর বাংলাদেশে এসে বাহাদুরাবাদের কাছে ময়মনসিংহের দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র বামদিকে বের হয়ে গেছে। ডানদিকে যমুনা। তার ওপর যেটাকে আমরা যমুনা বলছি, সেটা খুবই নবীন নদী। ফলে নদীটি এখনো থিতু হতে পারেনি। যে কোনো সময় যে কোনো দিকে ভাঙন দেখা দিতে পারে। আপনি দেখবেন, দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ হলো এই নদী। অন্যান্য নদীর লাখ লাখ হাজার হাজার বছর বয়সের সঙ্গে তুলনা করলে যমুনা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র সেদিন, ১৮৩০ সালের পর।
কালবেলা : নদীটি ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে দিক পরিবর্তন করেছিল না?
শেখ রোকন : এ ক্ষেত্রে অনেকে আসলে ভুল করেন। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্প ও প্রবল বন্যা ও ঢল হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তার ফলে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নয়, গতিপথ পরিবর্তন করেছিল আসলে তিস্তা। আগে তিস্তা দিনাজপুরের কাছ থেকে তিনটি ধারায়, করতোয়া, আত্রাই, পুনর্ভবা—এ তিন নদীর মাধ্যমে পাবনা অঞ্চল হয়ে গঙ্গায় পড়ত। যে কারণে এর নাম ‘ত্রিস্রোতা’ বা তিস্তা। ওই বন্যার ফলে তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করে রংপুর অঞ্চল হয়ে চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপুত্রে পড়ে। এই পানির চাপ ব্রহ্মপুত্র নিতে না পেরে ধীরে ধীরে নতুন প্রবাহ তৈরি করে। তবে এ ক্ষেত্রে এক রাতে তো নতুন নদী হয়নি। ধীরে ধীরে যমুনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৭৮৭ সালের পর প্রায় ৪০ বছর লেগেছিল। ফলে যমুনার সৃষ্টি হয় ১৮৩০ সালের পর। এর বয়স এখনো ২০০ বছরও হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই খুবই অস্থির নদী এটা।
কালবেলা : কিন্তু যমুনা নদীতে তো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
শেখ রোকন : মূলত বিভিন্ন তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বা শহররক্ষা বাঁধ বা বেড়িবাঁধ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যমুনা নদীতে। এর বাইরে নদীভাঙন প্রতিরোধে কিছু প্রকল্প আছে, বঙ্গবন্ধু সেতুর জন্য নদীশাসন প্রকল্প আছে। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে আলোচ্য প্রকল্পের মৌলিক পার্থক্য হলো, এতে গোটা নদীর প্রশস্ত কমিয়ে ১৫-২০ কিলোমিটার থেকে ৬-৭ কিলোমিটারে সংকুচিত করা হবে। যমুনার মতো নদীতে এটা কারিগরিভাবেই সম্ভব নয়।
কালবেলা : কেন সম্ভব নয়?
শেখ রোকন : কারণ নদীটির কাঠামোগত নাজুকতা ও প্রবাহের পরিমাণ। পার্বত্য নদী পললভূমিতে এসে এমনিতেই অস্থির থাকে। তাকে যে চাপের মধ্য দিয়ে চলতে হয়, সেটার শোধ তোলে যেন সমতলে এসে। যে কারণে আপনি দেখবেন, যমুনা সমান্তরালে ৫-৭টি ধারা। চর সৃষ্টি করে সমান্তরালে বয়ে চলছে। এ ধারাগুলো আবার স্থায়ী নয়। এ বছর এদিক দিয়ে যাচ্ছে তো আরেক বছর আরেক দিক দিয়ে যাবে। প্রায় প্রত্যেকবার বন্যার পর আগের ধারাগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয়। যমুনাকে অনেকে ব্রেইডেড বা বিনুনিপ্রবাহের নদী বলেন। কিন্তু সেটা আসামের দিকে সত্য হলেও বাংলাদেশে এসে যমুনায় এখনো বিনুনিপ্রবাহও স্থির হয়নি। কেউ কেউ বলেন, আরও কয়েকশ বছর লেগে যাবে। ফলে এর তীরে যদিও নানা প্রকল্প সম্ভব, নদী খাতের ভেতরে স্থাপনা বা অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও টেকসই করা প্রায় অসম্ভব।
কালবেলা : প্রবাহের বিষয়টি বলছিলেন।
শেখ রোকন : প্রবাহের দিক থেকেও যমুনা দেশের সবচেয়ে বড় নদী। একটা হিসাব দিই আপনাকে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ বাকি ৫৩টি যে পরিমাণ পানি বহন করে, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা একাই তার চেয়ে বেশি পানি বহন করে। আর বর্ষাকালে প্রবাহের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়, দুই কূল ছাপিয়ে যায় প্রবল বন্যা। যেমন শুকনো মৌসুমে এই নদীর পানিপ্রবাহ ৩৪-৩৫ কিউসেক। কিন্তু বর্ষায় এটা এক লাখ কিউসেক ছাড়িয়ে যায়। এই বিপুল প্রবাহ ও স্রোতে সংকুচিত করার স্থাপনা উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
কালবেলা : কিন্তু নদীভাঙন প্রকল্পগুলো তো টিকে থাকছে?
শেখ রোকন : দেখুন, কুড়িগ্রামের চিলমারী, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, চৌহালি বা টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর রক্ষায় গত ৫০ বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু ভাঙন কি থেমেছে? যমুনাকে বশে আনা সহজ নয়, আমার মতে চেষ্টাও করা উচিত নয়।
কালবেলা : প্রবাহ ছাড়া আর কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
শেখ রোকন : প্রবাহের সঙ্গে আপনাকে তলানিপ্রবাহ বা সিল্টেশনের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। যমুনা নদীতে এক বছর খনন করলেই পরের বছর বন্যার পর ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে আসামেও ব্রহ্মপুত্র নদী খনন প্রকল্প টেকসই হয়নি।
কালবেলা : এ ধরনের প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক দিকও তো রয়েছে।
শেখ রোকন : অবশ্যই এর দুটো দিক রয়েছে। প্রথমত, অভিন্ন বা আন্তঃসীমান্ত নদীতে আপনি প্রকল্প নিলে অববাহিকার অন্যান্য দেশের মতামত নিতে হবে। বিশেষত আপনি যদি ভাটির দেশ হন, তাহলে আরও বেকায়দায় থাকবেন। দ্বিতীয়ত, আপনি বাংলাদেশ অংশ ২৩০ কিলোমিটার যমুনা বা ব্রহ্মপুত্র সংকুচিত করলেন, ভারতের অংশ সেটা অবারিতই থাকল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য, কিন্তু উজানে তো সেই প্রকল্প নেই। ফলে নদীর প্রবাহ যদি অন্যদিক দিয়ে যেতে চায়, তাহলে তো মহাবিপর্যয় ঘটে যাবে।
কালবেলা : আমাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মৎস্যসম্পদেও ক্ষতি হবে।
শেখ রোকন : অবশ্যই ক্ষতি হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, যমুনা বা যে কোনো নদীর মৎস্যসম্পদের আবাসন ও প্রজননের বিষয়টি নির্ভর করে জলাভূমির সঙ্গে এর সম্পর্কের ওপর। কারণ কোনো মাছ নদীতে বাস করে, প্রজননের সময় বিলে চলে যায়। আবার কোনো মাছ বিলে বাস করে, প্রজননের সময় নদীতে চলে যায়। যদি যমুনা সংকোচন করা হয়, তাহলে মাছের এই জীবচক্রের কী হবে? নদীর সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্কের কী হবে?
কালবেলা : আপনি একবার বলেছিলেন, জলাভূমি বন্যা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।
শেখ রোকন : ঠিকই বলেছেন, যমুনার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি বাস্তব। জলাভূমির সঙ্গে নদীর সম্পর্কচ্ছেদ মানে হচ্ছে প্রবাহের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। কারণ বন্যার সময় নদী তার পানি বিল-ঝিলে জমা রাখে, ছোট-ছোট শাখা নদীগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। পরে সারা বছর শুকনো মৌসুমে সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি আসে। প্রতিবেশগত এ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। বন্যার তীব্রতা ও ভাঙনের হার বেড়ে যাবে। শুধু বন্যা মৌসুমেই যে বিপর্যয় দেখা দেবে, সেটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের।
কালবেলা : কিন্তু প্রকল্পটির প্রস্তাবকারীরা বলছে যে, যমুনা নদী ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে, এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
শেখ রোকন : আমি বলব, সেটা তারা ঠিকই বলছেন। যমুনা প্রতিবছর প্রশস্ত হচ্ছে, এর ফলে তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে, নৌ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, ভাঙন ও উদ্বাস্তু বাড়ছে। এগুলো সবই ঠিক আছে। কিন্তু দাওয়াই হিসেবে যে প্রকল্প দিয়েছেন তারা সেটা বাস্তসম্মত নয়, বাস্তবায়নযোগ্য নয়, টেকসইও হবে না। শুধু শুধু ঋণ করে ও রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ খরচ হবে। বিনিময়ে দুর্যোগ আরও বাড়বে। বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ বিবেচিত যমুনা নদীটি শেষ হয়ে যাবে।
কালবেলা : প্রশস্ততা কমানোর জন্য তাহলে কী করতে হবে?
শেখ রোকন : প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে, সেটা যমুনা নদীর মতিগতি বুঝে নিতে হবে। যমুনার মতো বৃহৎ ও বিশাল নদীকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। নিশাত স্যার প্রায়ই বলেন, রেসপেক্ট দ্য রিভার। নদীকে সমীহ করতে হবে। যমুনার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি জরুরি। যমুনার পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক রেখে প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে।
কালবেলা : যেমন পরিবেশসম্মত ব্যবস্থার উদাহরণ দিতে পারেন?
শেখ রোকন : যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাতেই শত শত বছর ধরে এক ধরনের লোকায়ত ও ঐতিহ্যগত নদী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি রয়েছে। এখনো আপনি উত্তরবঙ্গ, আসাম, নেপাল, ভুটানে দেখতে পাবেন। এটাকে বলে বান্ধাল। শুধু বাঁশ ও ধইঞ্চা দিয়ে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে ভাঙন কমে, নদীর নাব্য বাড়ে, ধীরে ধীরে ভূমি উদ্ধার হয় এবং প্রশস্ততা কমে আসে। যমুনার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রকল্প নিতে হবে। ১১০০ কোটি টাকা অবাস্তব প্রকল্পে উড়িয়ে না দিয়ে ২৩০ কিলোমিটার জুড়ে দুই পাড়ে প্রায় ৫০০ বান্ধাল করতে পারে। এতে খরচ অনেক কম পড়বে এবং সেটা পরিবেশসম্মত ও টেকসই হবে।
কালবেলা : এ ধরনের প্রকল্প নিতে অসুবিধা কোথায়?
শেখ রোকন : প্রশ্নটা অসুবিধার নয়, বরং সুবিধার। বান্ধালের মতো প্রকল্পে মাত্র কয়েক লাখ টাকা লাগে। তাহলে আর কী থাকল? আপনি শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে সেখানে অনেক সুবিধা না? যে কারণে উর্বর মস্তিষ্ক থেকে যমুনা নদীকে সংকুচিত করে ফেলার প্রকল্প আসে। বিশেষজ্ঞরা, পরিবেশবাদীরা যেহেতু প্রকল্পটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, সে জন্য তাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে, কোনো আলোচনা করা হয়নি। আপনাদের প্রতিবেদনে দেখলাম, এমনকি তারা সম্ভাব্যতাও যাচাই করেনি। আধুনিক রাষ্ট্রে এ ধরনের প্রকল্প সম্ভব নয়। শুধু হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীরাই এ ধরনের প্রকল্প নিতে পারে।
কালবেলা : আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ রোকন : আপনাকেও ধন্যবাদ।