প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেল!

জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেল!

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মোটামুটি আট মাস বাকি। এখন সব আলোচনা জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই। দেশে তো বটেই, বিদেশেও সবাই তাকিয়ে আছে আগামী নির্বাচনের দিকে। এর মধ্যেই ঘোষিত হয়েছে দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তপশিল। আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি নির্বাচন দিয়ে শুরু হবে এ নির্বাচনের পর্ব। ১২ জুন অনুষ্ঠিত হবে খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন হবে রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচন। জাতীয় রাজনীতিতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এ নির্বাচনে যেহেতু সরকার পরিবর্তন হবে না, তাই এ নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা খুব বেশি নেই। তা ছাড়া রমজানের কারণে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে পাঁচ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে তাদের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। আর বিএনপি যথারীতি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। আর বিএনপি নির্বাচনে না গেলে আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভারভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে পারবে।

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব না থাকলেও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এ পাঁচ সিটি নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে রাজনীতিতে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে। আর আন্দোলনের যুক্তি হিসেবে তারা ২০১৪ ও ’১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সামনে আনছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই। তাই সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগও তাদের নেই। বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। তবে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, বিরোধী দলের এ অভিযোগের খুব ভালো জবাব নেই তাদের কাছে। ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচন যে ভালো হয়নি, এটা সবাই জানেন। সরকারি দলের নেতারাও আড়ালে-আবডালে এ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অস্বস্তির কথা গোপন করেন না। আর বর্তমান বাস্তবতায় শুধু দেশে নয়, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে বিদেশিদেরও। তাই বর্তমান সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই এমন একটি আবহ তৈরি করা সরকারের জন্য খুবই জরুরি। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে পারে সেই আবহ তৈরিতে বর্তমান সরকারের শেষ সুযোগ। বিএনপি অংশ না নিলে পাঁচ সিটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সরকার যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারে, তবে বিএনপির আন্দোলনের বিপক্ষে সেটা একটা বড় যুক্তি হবে। গত অনেক দিন ধরেই বিএনপি অংশ না নেওয়ায় বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে অনেকটা একতরফাভাবে। তাতে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরই মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তাই ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এমনকি দেশে আওয়ামী লীগ সমর্থক যারা আছেন, তারাও ভোটকেন্দ্রে যান না। তাই অনেক দিন ধরেই দেশে ভোটকেন্দ্র মানেই খাঁখাঁ মরুভূমি। আগের সেই লম্বা লাইন আর দেখা যায় না। ভোট মানেই যে বাংলাদেশে উৎসব, সেটা ভুলতে বসেছে সবাই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবে না। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা যদি জানেন, তারা ভোট না দিলেও তাদের প্রার্থী জিতবে, তাহলে কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ থাকবে না। তাই পাঁচ সিটি নির্বাচনে জয়ের চেয়েও আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নির্বাচনী উৎসব ফিরিয়ে আনা, ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করা। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। নির্বাচন যেমনই হোক, বিএনপি সেটা মানবে না। কিন্তু দেশের সুশীল সমাজ এবং বিদেশিদের সামনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আবহ তৈরি করাটাই আওয়ামী লীগের কাছে জয়ের চেয়েও বড় গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি নিজেদের প্রার্থীর পরাজয়ের বিনিময়ে হলেও। আওয়ামী লীগ যদি সত্যি পাঁচ সিটি করপোরেশনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন করতে পারে, বিএনপির আন্দোলনের যুক্তি কমে আসবে। বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের ওপর চাপ বাড়বে। তাই পাঁচ সিটি নির্বাচনে কে জিতবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—নির্বাচন কেমন হবে। কখনো কখনো জয়ের চেয়ে, সাময়িক পরাজয় সামনে বড় জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাই পাঁচ সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি ড্রেস রিহার্সেল।

বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচনের দিকে তাদের প্রখর নজর থাকবে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ নির্বাচনে অংশ নেয় কি না, সেটার দিকে নজর তো রাখতে হবেই। কেউ আবার উকিল আবদুস সাত্তারের মতো পল্টি মারেন কি না, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। তবে বিএনপি তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সরকারি দলের প্রার্থীরা যদি হেরে যায়, তাহলে তারা বড় গলায় বলতে পারবে, প্রমাণিত হলো, এ সরকারের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। আর যদি জিতে যায়, তাহলেও বলতে পারবে, আমরা আগেই বলেছি, এ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে এ দ্বিমুখী সুবিধাটা বিএনপির জন্য বুমেরাংও হয়ে যেতে পারে। সত্যি যদি সিটি নির্বাচন ভালো হয়েই যায়, তাহলে কিন্তু বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হবে। তখন নির্বাচনে না যাওয়াটা তাদের জন্য নতুন সংকট ডেকে আনবে।

তবে সংকটটা সবচেয়ে বড় নির্বাচন কমিশনের জন্য। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ার অবস্থানের কারণে বিএনপি কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায়ও অংশ নেয়নি। তারা বারবার বলছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। কিন্তু যারা এখনো বড় কোনো পরীক্ষা দেয়নি, তাদের ওপর সরাসরি আস্থা নেই, বলাটাও সংগত নয়। এখন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো, নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করা। দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, তা মুখে বললে হবে না, বাস্তবে প্রমাণ করতে হবে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচন ছিল তাদের জন্য প্রথম পরীক্ষা। কিন্তু সে পরীক্ষায় পাস করতে করতে শেষ পর্যন্ত গোল্লা পেয়েছে। মাঠে ভালো নির্বাচন হলেও ফলাফল ঘোষণায় গিয়ে ‘সকলি গরল ভেল’। তবে গাইবান্ধা উপনির্বাচন বাতিল করে দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কমিশন তার আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ রেখেছে। এখন কমিশন যদি সরকারের সহায়তায় একটা ভালো নির্বাচন করতে পারে, তাহলে বিরোধী দলের ওপর উল্টো চাপ তৈরি হবে।

সব মিলিয়ে পাঁচ সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী নির্বাচনের সত্যিকারের ড্রেস রিহার্সেল। এ নির্বাচনে কে জিতবেন, কে হারবেন; তা শুধু ভোটের অঙ্কে নির্ধারিত হবে না। ভোটের বাইরে আরও অনেক হিসাব থাকবে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, কারা অংশ নেবে, তার অনেক কিছুই নির্ভর করছে আগামী পাঁচ সিটি নির্বাচনের ওপর। তাই আপাত গুরুত্বহীন সিটি নির্বাচনই হয়ে উঠতে পারে আগামী রাজনীতির গতিপথ।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনে ঝুলছিল নারীর মরদেহ

‘মধ্যপ্রাচ্যে শেখ হাসিনার মতো নেত্রী থাকলে গাজায় এমন পরিস্থিতি হতো না’

সাইকেল হয়ে গেল মোটরসাইকেল!

বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা চালু করল রাকাব

রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় নিহত ৩

শহরে কৃষক লীগের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না : কাদের 

মার্কিন মুলুকে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলকে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঙ্কার

বান্দরবানের সেই ব্যাংক ম্যানেজারকে চট্টগ্রামে বদলি

পাবনা কারাগারে কয়েদির মৃত্যু

জামায়াতের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

১০

ফরিদপুরে আবারও সড়ক দুর্ঘটনা / মাইক্রোবাস-মাহিন্দ্রার সংঘর্ষে নিহত দুই

১১

নৌপথে মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাসদস্যদের ফেরত পাঠাবে বাংলাদেশ

১২

তীব্র দাবদাহে রাজশাহীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ

১৩

মালয়েশিয়ায় শোষণের শিকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা : জাতিসংঘ

১৪

‘গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে’

১৫

বন্যপাখি খাঁচায় বন্দি করে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ পালন

১৬

অনলাইনে ভাবির নগ্ন ছবি প্রকাশ দেবরের, অতঃপর...

১৭

আতিফের জন্য হাহাকার 

১৮

টেকনাফ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে আরও ১৩ বিজিপি সদস্য

১৯

৪ জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

২০
*/ ?>
X