মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদ মানে সম্প্রীতির বন্ধন

ঈদ মানে সম্প্রীতির বন্ধন

দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এলো পবিত্র মাহে রমজান। দিন গেলেই আকাশে সন্ধ্যার রক্তরাগে উদয় হবে নতুন চাঁদের এবং দেশব্যাপী পালিত হবে আনন্দময় ঈদুল ফিতরের উৎসব। এরই মধ্যে অনেকের মনে গুঞ্জরিত হচ্ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সেই গানের সুর ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। পবিত্র ঈদুল ফিতরের উৎসব ঘিরে বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দের ঢেউ। কারণ ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি ভাগাভাগি করা। ঈদ মানে আত্মত্যাগের মহিমায় নিজেকে শানিত করা। ধনী-গরিব এক কাতারে দাঁড়ানো, একই আনন্দে হারিয়ে সাম্যের নিদর্শন স্থাপনের নামই ঈদুল ফিতর। বছরে একবার এই উৎসব দিবসটি খুশি ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে ফিরে আসে। এ জন্য এটাকে ঈদ বলা হয়। মহান আল্লাহ প্রতিবছর ঈদের মাধ্যমে বান্দাকে তার দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন। সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সাম্যবাদিতা ও মনুষ্যত্বের গুণাবলি দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আগমন হয়।

এরই মধ্যে ঈদুল ফিতরের নামাজের জামাতের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে রাজধানী ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দান, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়াসহ দেশের বড় বড় মসজিদ ও ঈদগাহ। অনেকেরই ঈদ আনুষঙ্গিক কেনাকাটাও প্রায় শেষ। এখন অপেক্ষা ‘শাওয়াল’ মাসের চাঁদের। আকাশের পশ্চিম কোণে খুশির বারতা নিয়ে দেখা দেবে একফালি চাঁদ। তাতে ঝরতে থাকবে খুশির জ্যোৎস্না। শুরু হবে খুশির ঈদ-আনন্দ উৎসব। মুসলমানের জন্য ঈদের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ একটি ইবাদত। আনন্দ ও ফুর্তির মাধ্যমেও যে ইবাদত-বন্দেগি পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়তসম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশের বিষয়ে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (সুরা ইউনুস : ৫৮)।

ঈদ মানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে আনন্দ, উৎসব ও সম্প্রীতির ভাগাভাাগি করা। ঈদের সামাজিক উদ্দেশ্যর অন্যতম হলো, সমাজের অসহায়-নিঃস্ব মানুষকে সহযোগিতা করা। প্রতিটি ঘরে আনন্দ ও খুশিকে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই শরিয়তে ঈদুল ফিতরের সময় সদকা আদায় এবং ঈদুল আজহায় কোরবানির মতো আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিধান আছে, যেন ঈদের আনন্দে সমাজের সব শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ কোনো মুমিনের পার্থিব কোনো বিপদ-সংকট দূর করলে মহান আল্লাহ তার আখিরাতের সংকট দূর করবেন। মানুষ কারও সহযোগিতা করলে আল্লাহ তারও সহযোগিতা করেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৯৯৬)। সাহাবি আউস আল আনসারি (রা.) বলেন, নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ফেরেশতারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশে বলতে থাকেন—হে মুসলমানরা! তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে এসো। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সওয়াব প্রাপ্তির জন্য। তোমাদের রাত্রিবেলা নামাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মোতাবেক নামাজ পড়েছ। তোমাদের দিনে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ পালন করেছ। এক মাস রোজা রেখেছ। গরিব-দুঃখীদের আহার করানোর মাধ্যমে নিজের প্রতিপালককে আহার করিয়েছ। এখন নামাজ পড়ে এসব পুণ্য কর্মের প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ করো।’ ঈদের নামাজ পড়ার পর একজন ফেরেশতা ঘোষণা দেন, শোনো নামাজ আদায়কারীরা! তোমাদের মহান রাব্বুল আল-আমিন মাফ করে দিয়েছেন, সব গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আজ পুরস্কার দেওয়ার দিন। আকাশে এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’। (মুজামুল কাবির লিত তাবারানি : ৬১৭)।

ঈদের মানবিক উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর নানা দেশ, জাতি ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সবার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ মনোবল গড়ে তোলা। অসংখ্য মুসলিম মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আনন্দের দিনটি অতিবাহিত করে। সমাজে আনন্দ-উৎসাহের দারুণ এক চিত্র ফুটে ওঠে এই দিনে। তাই মুসলিম সমাজে আনন্দ প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন একতা থাকে, ঠিক তেমনি দুঃখ-কষ্টের সময়েও পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একতা থাকা চাই। মুসলিম সভ্যতায় নানা দেশের নানা ভাষার মানুষের মধ্যে অভিন্ন চিন্তাধারা সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে ঈদের ভূমিকা অপরিসীম। রাসুল (সা.) পারস্পরিক মমতাবোধ ও সহযোগিতার শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় মুমিনদের উপমা একটি দেহের মতো। দেহের একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হলে পুরো দেহ সজাগ হয়ে ওঠে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)

ঈদুল ফিতরের দিনের অন্যতম আমল হলো ফিতরা আদায় করা। ইসলামে ফিতরার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি জাকাতেরই একটি প্রকার। রাসুল (সা.) হাদিস ও সুন্নাহয় তা আদায়ের তাগিদ করেছেন এবং এর নিয়মনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণেই রাসুলের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ ইসলামের পাঁচ রোকন ও দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক আমল ও ইবাদতের মতো সদাকাতুল ফিতরও নিয়মিত আদায় করে আসছে। আমাদের এ অঞ্চলে তা ‘ফিতরা’ নামে পরিচিত। ঈদের আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরিক হতে পারে এ জন্য ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে। এতে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিও পূরণ হয়ে যায়। একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয় তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকের আহার জোগানোর জন্য। (আবু দাউদ : ১৬১১)। অন্য হাদিসে এসেছে, আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সদকায়ে ফিতর আদায় করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার রোজা জমিন ও আসমানের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে।’ (কানযুল উম্মাল : ২৪১২৯)

ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে সদকাতুল ফিতর ও জাকাতের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন জাকাতের ক্ষেত্রে সম্পদ বৃদ্ধি পায় এমন সম্পদ হতে হবে। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে এমনটি নয়। জাকাতের সম্পদ পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হতে হয়, কিন্তু সদকাতুল ফিতর তাৎক্ষণিক ওয়াজিব হয়। (ফাতহুল কাদির : ২/২৮১)। এমনকি ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় কোনো নবজাতক দুনিয়ায় এলে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/১৯২)। আমরা সবাই ঈদের প্রস্তুতি নেব। প্রয়োজনীয় অন্ন-বস্ত্র ও আনন্দ-বিনোদন পূরণের সবটুকু চেষ্টা করব। এ প্রস্তুতির পাশাপাশি আল্লাহর জন্য আরেকটি প্রস্তুতি নেওয়াও জরুরি, সেটাও স্মরণে রাখব। অসহায়-অনাথদের কষ্ট লাঘবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করব। পড়শি ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেব। তাদের সন্তানদের খোঁজ নেব। আনন্দে তাদেরও শরিক করব। অন্তত সুন্দর কথা বলে কিংবা মিষ্টি হাসি দিয়ে তাদের সঙ্গে থাকব। তবেই ঈদ হয়ে উঠবে প্রকৃত আনন্দের উৎসব।

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ম্যানসিটি-আর্সেনালের দিকে তাকিয়ে ক্লপ

ভোলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়

উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির দুই নেতাকে শোকজ

যে কারণে চাকরি ছাড়লেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫৭ কর্মকর্তা

শনিবার শুরু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা, জবিতে পরীক্ষা দেবেন অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী

হিটস্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

তীব্র গরমে ঢাকার বাতাসের কী খবর

ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে চায় আর্জেন্টিনা

হজ পারমিট দেওয়া শুরু করেছে সৌদি আরব

নওগাঁয় বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ আদায়

১০

হঠাৎ বার্সা কোচের ‘ইউটার্ন’

১১

শপথ নিলেন আপিল বিভাগের ৩ বিচারপতি

১২

তীব্র গরমের মধ্যেই শিলাবৃষ্টির আভাস

১৩

যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

১৪

উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির দুই নেতাকে শোকজ

১৫

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য পাকিস্তানে যাচ্ছে না ভারত!

১৬

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান আটকে দিল কুমির, ভিডিও ভাইরাল

১৭

কী আছে আজ আপনার ভাগ্যে

১৮

নাটোরে ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৯

শ্রমিক সংকটে বোরো চাষিরা

২০
*/ ?>
X