সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শাসনব্যবস্থার যোগ

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শাসনব্যবস্থার যোগ

গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল। দীর্ঘ সময় কম মূল্যস্ফীতির যে প্রবাহ তাতে এটি একটি বড় ধাক্কাই ছিল বলা যায়। তবে এর পর থেকে তা কমতে থাকে এবং এই ফেব্রুয়ারিতে তা এসে দাঁড়ায় ৮.৭৮ শতাংশে, যদিও জানুয়ারিতে ছিল ৮.৫৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে শুধু খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়েই সবসময় বেশি চিন্তা থাকে। এখন অবশ্য খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার মূল্যস্ফীতি নিয়েও দুশ্চিন্তা চলছে। বরং বলা যায় অনেকদিন ধরেই খাদ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিই বেশি।

ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরে বিভিন্ন স্থাপনা ও বস্তিতে আগুন লাগা নিয়মিত বিষয়। সম্প্রতি বেশ কিছু বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনায় বহু প্রাণ গেছে। নিত্যপণ্যের বাজারেও আগুন লেগেছে এবং এটি সবসময়ের। সে আগুন মূল্যবৃদ্ধির আগুন। দেশি-বিদেশি বাজারে কাঁচামালের আগুনদর ও অপ্রতুলতা উৎপাদন শিল্পকে বিপাকে ফেলেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ কাঁচামাল বা অন্তর্বর্তী পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তার মূল্যবৃদ্ধি দেশের বাজারে আগুন লাগিয়েছে। জ্বালানির উচ্চমূল্যের প্রভাব সর্বত্র লক্ষণীয়। প্রতি মাসে বাড়ছে বিদ্যুতের মূল্য। ফলে কলকারখানায় উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যও নিম্নমুখী, ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে যা অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। অন্য দিকে, ডলারের সংকটও দৃশ্যমান। এসবের কারণে অস্বাভাবিক আমদানি খরচ সামগ্রিক মূল্যস্তরকে ঠেলে তুলছে।

এমন বাস্তবতায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। তার ওপর, কভিড-১৯ আর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সাধারণ চাকরিজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কর্মসংস্থান হারিয়েছে, রোজগার কমেছে। সিন্ডিকেট নামের মজুতদারির কথা সবাই বলে, কিন্তু নিত্যপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকার যারা পেয়েছে তারা বা তাদের প্রতিনিধিরা নীতিনির্ধারণী জায়গায় অবস্থান করায় পুরো বাজার পরিবেশটাই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে চেহারা নিয়েছে। অর্থাৎ সব মিলে সমস্যা এখন অন্তহীন।

সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নতুন কথা নয়। প্রায় সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সাধারণ মানুষের হাত পোড়ে। গরিব মানুষের কথা বাদই দিলাম, মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে বাজারে। অস্বাভাবিক বেড়েছে ভোজ্যতেল ও চালের মূল্য। বেড়েই আছে সবজি ও ডিমের দাম। মাংসের দাম এত বেড়েছে যে, হাত দেওয়ার সাহস খুব বেশি মানুষের নেই। তাই এখন সুপারশপগুলোও গ্রাম হিসেবে মাংস বিক্রি করছে, টুকরো করে মুরগি বিক্রি শুরু হয়েছে। ভোজ্যতেলের মূল্য প্রতিদিন চড়চড় করে বেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণ বাড়িতে তেল দিয়ে খাওয়া যেন আজ বিলাসিতা এবং সেটা আসন্ন রমজানে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা ভাবাও ভীতিকর হয়ে পড়েছে। চিনির বাজারে এখনই সংকট এবং রমজানে তারও এক অস্বাভাবিক অবস্থা হতে চলেছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শাসনব্যবস্থার সম্পর্ক আছে। মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায় এবং একই সঙ্গে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। ফলে খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে পারে না বেশিরভাগ মানুষ। বাধ্য হয় এসব ব্যয় কাটছাঁট করতে, এমনকি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ থেকেও বহু মানুষকে বিরত থাকতে হয়। মূল্যস্ফীতির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অনিবার্যভাবেই জীবনযাত্রার মান পড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই চাপে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ এমনিতেই দিশাহারা। এর মধ্যে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে এবং বিশ্ববাজারে কমার পরেও কমাচ্ছে না। এদিকে এখন শুরু হয়েছে মাসে মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো। বুঝতে বাকি নেই যে, এসব পণ্যের ওপর ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে আইএমএফের চাপে। দফায় দফায় যদি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম এভাবে সরকারকে বাড়াতে হয়, তবে তাকে মানুষের জন্য শাসনব্যবস্থা বলা যা য় কি না ভেবে দেখা দরকার।

মূল্যস্ফীতির বড় বিপদটা হলো—এটি দৃশ্যমান নয়। নীরবে ক্ষয় করে যায় মানুষকে। সরকারও এমনসব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে যা নিয়ে মানুষ সরাসরি কিছু বলতে পারছে না। এবং সেই রাজনীতিটাও নেই দেশে। শাসক দল মানুষের জন্য রাজনীতির কথা বললেও জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে মানুষের কষ্ট নিয়ে একটি কথাও বলছে না, বিরোধী পক্ষও সেভাবে কোনো আন্দোলন জমাতে পারেনি। বিদ্যুতের মূল্য এখন যেভাবে নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হচ্ছে তা এক কথায় মানুষবিরোধী, কিন্তু মানুষের জন্য কথা বলবার কেউ নেই। আগেই যেসব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছিল, সরকারের জ্বালানি নিয়ে এমন সব সিদ্ধান্তে সেগুলোর দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের প্রোটিন ও পুষ্টির বড় উৎস ডিমের দাম যেমন নিয়ন্ত্রণহীন, তেমনি এখন ব্রয়লার মুরগির দামও সাধারণের নাগালের বাইরে। মাছ ও সবজিও অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে মানুষকে। চালের দাম কোনোভাবেই স্থিতিশীল হচ্ছে না, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দামও বেশ চড়া। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ ভাবনার বাইরে, কারণ কাগজের দাম এখন আকাশচুম্বী।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর প্রথম কিস্তির ছাড়ও পেয়েছে। কিন্তু এ কারণে ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। আইএমএফ যেসব সংস্কারের শর্ত দিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির খাতগুলোর—এ ধরনের সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা তখন তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি। অর্থনীতি যখন একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে সময় একবারে এতগুলো সংস্কার অনিবার্যভাবেই অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি করবে। মূল্যস্ফীতির বোঝা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দুর্দশা সে কারণেই এখন অসহনীয়।

আগেই বলেছি খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মানুষ স্বভাবতই কম দামি খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকে। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন, ভিটামিন ও বিবিধ পুষ্টিগুণসম্পন্ন অণুখাদ্যের মাত্রা কমতে থাকলে তার প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্যদের ওপরে। পৌষ্টিক আহারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব গিয়ে পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। সুষম আহার না পেলে শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, তাদের মানসিক বিকাশ যথাযথ হতে পারে না। কর্মক্ষমতায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ঠিকভাবে গড়ে উঠে না। তাই আন্তর্জাতিক বাজার বা খাদ্যপণ্যের লাগামহীন বৃদ্ধি সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রকাশ করে।

মনে রাখা দরকার, যে মূল্যস্ফীতির চাকা একবার গড়াতে শুরু করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি কঠিন। একটা সময় ছিল এই আওয়ামী লীগই পথঘাট কাঁপিয়ে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করত। ক্ষমতায় আসীন হয়ে এই দলের নেতারা এই সত্যটি এখন সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। কিন্তু কিছু পদক্ষেপ তো নেওয়া প্রয়োজন, সেটা কি তারা ভাববেন?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাজার কোটি টাকার মালিক বাবা, কিছুই জানে না ছেলে

প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে নৈরাজ্য-নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে : টিআইবি

শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ

ড. হাফিজের লেখা ‘আমরা মুক্তি সেনা’ 

২৫ রমজানের মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধের দাবি ডিইউজের

পূর্ণাঙ্গ উৎসব বোনাস ও সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের

শত পরিবারের জন্য আমাদের করণীয় রয়েছে : কামাল উদ্দিন আহমেদ

দিনমজুরের কার্ড হাতিয়ে ৮ বছর ধরে চাল আত্মসাৎ করেন ডিলার

হত্যার পর দুই ফিলিস্তিনিকে বুলডোজার দিয়ে বালুচাপা দিল ইসরায়েল

জনগণের প্রতিদান দিতে রাজপথ ছাড়ব না : আমিনুল হক 

১০

বিশ্ববাজারে সোনার দামে নতুন রেকর্ড

১১

নির্যাতন-নিপীড়নে বিএনপির আন্দোলন দমবে না : নোমান

১২

প্রেস ক্লাবে হামলার মামলায় সাংবাদিকসহ কারাগারে ৭

১৩

৭ এপ্রিলের পেতে অনলাইনে ১ কোটি ৫৭ লাখ হিট 

১৪

‘জলবায়ু সহনশীল মৎস্য চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে’

১৫

আমরা একটা দুঃসময় অতিক্রম করছি : মির্জা ফখরুল 

১৬

জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন ভারতের পূজা ব্যানার্জি

১৭

রেল কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় : রেলমন্ত্রী 

১৮

ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে মার্কিন প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ

১৯

কম্পিউটারের হার্ডওয়ার সমস্যার সমাধানে ‘কম্পিউটার হার্ডওয়ার সল্যুশন এ টু জেড’ 

২০
*/ ?>
X