সুলতান মাহমুদ
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দূষণ রোধে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন

দূষণ রোধে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন

জনবহুল অনেক দেশের মতো আমাদেরও অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। গত কয়েক দশকের ধারাবাহিকতায় যা চলছে এখনো। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার দৌড়েও কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। রাজধানী ঢাকার অনুকরণে অন্যান্য জেলা-উপজেলায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের খরগোশ গতি চলছে যথেচ্ছা। এ ধারায় অনেকটাই উপেক্ষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার মতো সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। যেনতেন উন্নয়নের স্রোতধারায় পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষ করে বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ গোটা জনগোষ্ঠীকে গিলতে বসেছে।

সর্বগ্রাসী দূষণের এ ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, প্রচলিত আইনের প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত বাস্তবায়ন জরুরি। আর এ জন্য প্রয়োজন দূষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ। স্বাস্থ্য কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বরাদ্দ থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে বা পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দের নজির নেই। গুরুত্ব বিবেচনায় কালবিলম্ব না করে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে দূষণবিরোধী টেকসই বরাদ্দ এখন সময়ের বড় চাওয়া হয়ে উঠেছে। পরিবেশ ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা দেশের প্রধান প্রধান বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।

অনেক শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা আমাদের দেশে কম হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে আমাদের পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়ানক রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষা পারদর্শিতাবিষয়ক সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬২তম। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে আমরা এগিয়ে রয়েছি, যা বড় উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই এক কোটির ওপর বেশি মানুষ দূষণে আক্রান্ত। স্বল্পায়তনে বেশি জনগোষ্ঠীর দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা বিশেষ করে দূষণ রোধে বহুমুখী উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব বিবেচনায় তার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নে নজর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সরকারি হিসাবে তিন বছরে করোনাভাইরাসে দেশে ৩০ হাজার মানুষ মারা গেছে। সে হিসাবে গড়ে এ ভাইরাসে মারা গেছে ১০ হাজার মানুষ। তবে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনার চেয়েও ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে দূষণের (বায়ু, পানি ও মাটি) কারণে। এ হিসাব গড়ে দূষণেই মারা যায় ৯০ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের সবশেষ এক সেমিনারে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় বাজেট থেকে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ সে বিবেচনায় দূষণ কিংবা পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় বাজেট থেকে ব্যয়ের হিসাব কষলে তা তলানিতে নামবে।

চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) জাতীয় বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, অলোচ্য বছরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। আর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ চলতি বছরের জন্য যে অঙ্কে প্রদর্শিত হয়েছে তার কত কিয়দংশ দেশের পরিবেশ দূষণ ও স্থাস্থ্যঝুঁকি কমাতে ব্যয় হবে তার কিছুই নির্দিষ্ট নয়। এমনকি নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও। বাজেটে খোদ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আগের পাঁচ বছরের বরাদ্দ চিত্র অতিশয় নেতিবাচক। গত কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বছর বছর পরিবেশের জন্য বরাদ্দ কমার সমালোচনা করে পরিবেশবিদরা বলেছেন, দূষণ বাড়লেও বাজেট কমে পরিবেশের। আর এতে করে পরিবেশ সুরক্ষার সুফল মিলছে না।

২০২২ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে দূষণের তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। এতে দেখানো হয়েছে, মানুষের মৃত্যু বাদে শুধু বায়ুদূষণেই বাংলাদেশের বছরে ক্ষতি ১ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে এ বাবদ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে আরও কয়েক শতাংশ যোগ হবে। একই সঙ্গে সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এবং গ্রিনপিসের গবেষণায় বলা হয়েছে যে, দূষণে বিশ্বে প্রতিদিনের ক্ষতি ৮০০ কোটি ডলার। আর পরিবেশ দূষণের ক্ষতি ৬৫০ কোটি ডলার।

এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরিবেশ, দূষণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করা স্থানীয় গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) বলেছে, পরিবেশের সঙ্গে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির সুনির্দিস্ট ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে চারটি অভীষ্ট সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তার মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা, শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিশুদ্ধ পানির আওতায় আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিতকরণ ও সমুদ্র দূষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখে এসডিজি অর্জন অসম্ভব। তাই লক্ষ্য অর্জনে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়কেও এ তৎপরতায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

এসডোর মহাসচিব বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ডক্টর শাহরিয়ার হোসেনের মতে, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য একে অন্যের পরিপূরক। যত পরিবেশের ক্ষতি হবে ততই স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ বাড়ে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে। এ খাতে ক্রমাগত ভর্তুকি বাড়াতে হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে গিয়ে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেয় তা শেষে গিয়ে জাতীয় ব্যয়ে পরিণত হয়।

দূষণ, অপরিকল্পিত নগর ও শিল্পায়ন এবং সুশাসন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে সাংবাদিকদের নিয়ে বেসরকারি সংস্থা নিউজ নেটওয়ার্কের এক কর্মশালায় বলা হয়েছে, সরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিলেও দূষণ নির্মূল, পরিবেশ রক্ষা, রোগ প্রতিরোধ বা বিস্তার ঠেকাতে কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখছে না। ইউএসএইডের সহায়তায় আয়োজিত এ কর্মশালায় আরও বলা হয়, নগর ও নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ দিয়ে দূষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করা গেলে পরিবেশের যেমন সুরক্ষা হবে, তেমনি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমলে সার্বিক অর্থনীতির ওপরও চাপ কমে আসবে।

দেশের অন্যতম প্রধান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগও (সিপিডি) দূষণ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করেছে। আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটের জন্য এ খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় গত সোমবার সিপিডি তাদের বাজেট প্রস্তাবনায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। বাজেটের বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে গিয়ে ‘এক নিঃশ্বাসের তাজা বাতাসের জন্য বাজেট’ শিরোনামে বলেছে, বাংলাদেশের বাতাসে বিশ্ব নিরাপদ বায়ুর গুণগতমান নির্দেশিকার চেয়ে ১৩ দশমিক ২ গুণ ঘনত্ব বেশি। এ পরিস্থিতির উত্তরণে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আমদানি পণ্যে কর আরোপের প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে সরঞ্জামের ওপর ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছে। সংস্থাটি পরিবেশ দূষণকারী শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের ওপর ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপের পরামর্শ দিয়েছে।

সরকারের বাজেট সহায়তা ও যথাযথ নীতি কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দূষণ রোধ করা গেলে নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যেও উন্নতি ঘটবে। মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও।

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাইবান্ধায় গরু চুরি মামলার বাদীকে হত্যা

নেতানিয়াহুর জন্য ‘আশীর্বাদ’ হয়ে এসেছে ইরানের হামলা

টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিলেন না বুয়েট শিক্ষার্থীরা

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করলে প্রেমিকা দায়ী নন : দিল্লি হাইকোর্ট

কিশোরগঞ্জে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী মামা-ভাগ্নে নিহত

মা হারালেন বেবী নাজনীন

সেলস এক্সিকিউটিভ পদে নিয়োগ দেবে উইকন

মোস্তাফিজের ‘বিকল্প’ নিল চেন্নাই!

বিশ্ববাজারে কমছে সোনার দাম

৪ দিন পর জবিতে উদযাপিত হলো বাংলা নববর্ষ 

১০

মাদ্রিদের রক্ষণাত্মক কৌশলের সমালোচনা করতে চান না গার্দিওলা

১১

খোলা সয়াবিন তেলের দাম কমলেও বেড়েছে বোতলজাতের

১২

ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

১৩

পুকুর থেকে পলিথিনে মোড়ানো নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার

১৪

রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য আহরণ বন্ধ হচ্ছে ২৫ এপ্রিল

১৫

জামাইয়ের বাড়িতে শ্বশুর-শ্যালক মিলে চুরি

১৬

মালয়েশিয়া প্রবাসীদের জন্য সুখবর 

১৭

রক্ষণাত্মক খেলা ছাড়া সিটিকে হারানোর উপায় দেখছিলেন না আনচেলত্তি

১৮

স্নাতক পাসে ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ

১৯

আধিপত্য বিস্তারের জেরে কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষ, নিহত ১

২০
*/ ?>
X