বিশ্বকাপে নেই, আছে বাংলাদেশও

বিশ্বকাপে নেই, আছে বাংলাদেশও
বাংলাদেশের মানুষের এই ফুটবল ভালোবাসা, ফুটবল উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে।

কাতার বিশ্বকাপে নেই। আগের কোনো বিশ্বকাপেও ছিল না। আগামীতে আদৌ কোনো বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলতে পারবে কিনা, তাও জানা নেই কারোরই। কিন্তু বিশ্ব ফুটবল জগৎ জানে এখন বাংলাদেশের কথা। ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাতামাতির উন্মাদনা ফিফাই জানিয়েছে পৃথিবীকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণিত আর্জেন্টাইন ভক্তের খেলা দেখার ছবি ফিফার অফিসিয়াল পেজে পোস্ট করে ফুটবলের বিশ্বজনীন আবেদনের কথা বলেছে। এরপর ফিফা তাদের অফিসিয়াল পেজে ছাপিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ডের খেলা দেখার জনসমুদ্রের ছবি। ফিফার পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে, ‘ফুটবলের মতো আর কোনো কিছু মানুষকে একত্রিত করতে পারে না। গত রাতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দেখা গেল এই বিশাল জনসমাগম।’

এদিকে বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ভক্তদের কথা জেনেছে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনও। আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা চার কোটির মতো। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি—সেটিও এখন তারা জানে। সেই সম্মানে বাংলাদেশিদের জন্য ‘ভার্চুয়াল উপহার’ দিয়েছে আর্জেন্টিনার পেশাদার ফুটবল লিগ। তারা টুইটার ও ফেসবুকে ভেরিফায়েড পেজে বাংলাদেশের পতাকা হাতে মেসির একটি ছবি দিয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গোলের পর মাঠে ছুটছেন লিওনেল মেসি। তার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। ছবি পোস্ট করে আর্জেন্টিনার পেশাদার ফুটবল লিগ টুইটারে লিখেছে, ‘লিওনেল মেসি বাংলাদেশ।’ একইভাবে ফেসবুক পেজেও তারা ছবিটি দিয়ে লিখেছে, ‘লিওনেল মেসি বাংলাদেশ। এটাই সেই টুইট। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।’

মেসি এবং নেইমার ব্যক্তিগতভাবেও জানেন তাদের এবং তাদের দল নিয়ে বাংলাদেশের ভক্তদের উন্মাদনার কথা। তাদের পেজগুলোতে ঢুঁ মারা নেটিজেনদের মধ্যে বাংলাদেশের ফ্যানরা‌ প্রথম কাতারে।

কয়েকদিন আগে মিডিয়ায় খবর হয়েছে, বাংলাদেশই শুধু মেসিদের ভালোবাসে না, আর্জেন্টাইনরাও ভালোবাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। সেখানে বলা হয়েছে, আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশ কী কী ধরনের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। কী পরিমাণ করে এবং কী হারে ঊর্ধ্বগতিতে বাড়ছে সে রপ্তানি।

বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া অনেক দলের জার্সি তৈরি হয় বাংলাদেশে। সে খবরও ছাপা হয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বিশ্বকাপে নেই, তারপরও বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের ফ্যানদের উন্মাদনা—খবর হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ শুরু করতে পারে ফুটবল কূটনীতি, ফুটবল বাণিজ্য কূটনীতি।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন এবং তাদের স্পন্সরদের কাছে বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে সহযোগিতা চাইতে পারে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবলে রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তারা সহযোগিতা করতে পারে। তাদের যে একাডেমি আছে সেগুলোতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কিশোর ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ দিতে পারে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলোর জন্য এই দুই দেশের ফেডারেশন কোচ দিয়ে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলগুলোর সফর ও ওই দুই দেশের দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ খেলার এবং বয়সভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।

মেসি ও নেইমারের কাছে বা তাদের স্পন্সরদের কাছে বাংলাদেশে ‘মেসি ফুটবল একাডেমি’, ‘নেইমার ফুটবল একাডেমি’ তৈরির জন্য সহযোগিতা চাইতে পারে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। নেইমারের প্রচারের দলে রয়েছেন তার বন্ধু বাংলাদেশি এক তরুণ। তার সহায়তায় নেইমারকে বাংলাদেশে একটি ফুটবল একাডেমি করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। মেসি বা নেইমারের নামে ফুটবল একাডেমি তৈরির প্রস্তাব করলে তারা তাদের নিজস্ব ফান্ড থেকে বা স্পন্সরদের দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপারে তারা সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশে তাদের বিশাল ভক্তকুলের ব্যাপারে কিছু করতে নিশ্চয়ই তারা এগিয়ে আসবেন। সেটি যদি হয় ফুটবল-সংক্রান্ত, তবে নিশ্চয়ই সাড়া মিলবে।

গার্মেন্ট রপ্তানিকারকরা মেসি, নেইমার এবং আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনার প্রচার চালিয়ে এই দুই দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। এজন্য বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বাড়িঘর রাঙানো, পতাকা তৈরি, র‍্যালি, খেলা দেখার আয়োজনের যে পাল্টাপাল্টি প্রতিযোগিতা চলে, ঘরে ঘরে যে পতাকা উড়ে—এসব ছবি ও খবর ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পত্র-পত্রিকায়, টিভি-চ্যানেলে পাঠিয়ে প্রচারের সুযোগ তৈরি করলে বাংলাদেশের পরিচিতি ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি হৃদ্যতা তৈরি হবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার। ঢাকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কূটনীতিকদের সঙ্গে এ নিয়ে মতবিনিময় এবং নানা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফুটবল উন্মাদনাকে পুঁজি করে উদ্ভাবনী ফুটবল কূটনীতির মাধ্যমে কীভাবে লাভবান হওয়া যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা করা ও উদ্যোগ নেওয়ায় এখনই সক্রিয় হতে পারেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের মানুষের এই ফুটবল ভালোবাসা, ফুটবল উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে। আমরা চিরকাল শুধু বিশ্বকাপের দর্শক হয়েই থাকব, কোনোদিন খেলব না, এ তো হতে পারে না। অন্তত স্বপ্ন দেখা, পরিকল্পনা করা এবং সে পরিকল্পনা নিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছোটার উদ্যোগ নেওয়া তো দরকার।

লেখক : সাংবাদিক, ক্রীড়ালেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com