
২০২২ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি পাঠায়। বাংলাদেশ এমন সময় ঋণ সাহায্যের আবেদন করে, যখন শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, নিয়মিত বার্ষিক ঘাটতি বাজেট, জনতুষ্টিবাদী সস্তা রাজনীতি, অপরিকল্পিত অর্গানিক চাষ, কর হ্রাসকরণ, পর্যটন শিল্পে ধস, বিদেশি বিনিয়োগের অভাব, সিংহলী উগ্রজাতীয়তাবাদ প্রভৃতি কারণে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। একইভাবে পাকিস্তানে বন্যার ফলে সীমাহীন ক্ষতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি কারণে দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছিল। তখন উভয় দেশ পুনরুদ্ধার তহবিলের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। তখন প্রশ্ন ওঠে, তবে কি বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের পথে হাঁটছে? এ ক্ষেত্রে আইএমএফের পুনরুদ্ধার তহবিল ও সতর্কতামূলক তহবিল বোঝা প্রয়োজন। যখন একটি দেশের ব্যাংকের রিজার্ভ শূন্য হয়ে যায়, তখন ওই দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। তখন সে দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য আইএমএফের কাছে যে ঋণ চায়, তা হলো পুনরুদ্ধার তহবিল। অন্যদিকে যখন একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই কমে যায়, আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খায় এবং অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলে আসে, তখন দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচতে যে ঋণ আবেদন করে, সেটা সতর্কতামূলক তহবিল অর্থাৎ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার জন্য সতর্কতামূলক ঋণ সহায়তা চেয়েছে আইএমএফের কাছে। বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তির অন্যতম কারণ হলো রেডিমেট গার্মেন্ট শিল্পের অবিশ্বাস্য অগ্রসরতা ও বৈদেশিক রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি এবং কর্মক্ষম মানুষের আধিক্য।
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বাংলাদেশের রিজার্ভে জমা করে। আইএমএফ সাতটি কিস্তিতে ৪২ মাসের মধ্যে এই ঋণ দেবে। প্রতিষ্ঠানটি মোট তিনটি খাত থেকে এই ঋণ সহায়তা দেবে। ইসিএফ (এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি) তথা বর্ধিত ঋণ সহায়তা ও ইএফএফ (এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি) তথা বর্ধিত তহবিল সহায়তার অধীনে ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার এবং প্রতিষ্ঠানটির নবগঠিত তহবিল আরএসএফ তথা রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির আওতায় ১৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান করবে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এই আরএসএফের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি মূলত সেসব দেশকে ঋণ দেয় যেসব দেশ জলবায়ু অভিঘাতজনিত কারণে নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নাকানিচুবানি খায়। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ঋণ পাচ্ছে, যা বিনা সুদে পরিশোধ করতে হবে। আইএমএফের ঋণের সুদহার নির্ধারণ হবে বাজারদর অনুযায়ী, যা গড়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের স্বল্পতা। এর পেছনে অনেক কারণ নিহিত আছে। এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রিজার্ভের শক্তির অন্যতম দুটি উৎস হলো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। আমরা এর আগে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে নানা সময়ে বিদেশে অধিক পরিমাণে অর্থ পাচার হলেও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ভিত্তি বাংলাদেশের রিজার্ভকে ক্ষয় থেকে বারবার রক্ষা করেছে। রিজার্ভে যে ভয়াবহ সংকট তা রাতারাতি তৈরি হয়নি। করোনা-উত্তর পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ধরনের অভিঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক; কিন্তু দেশের সংকটের কারণ হিসেবে শুধু এটিকেই মুখ্য করে তুললে নিঃসন্দেহে তা হবে সত্যের অপলাপ। এই সংকটের সূত্রপাত যুদ্ধের ছয় মাস আগে থেকেই পরিলক্ষিত। রিজার্ভের জমার তুলনায় খরচই বেশি হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে রিজার্ভ থেকে নানা প্রকল্পে ব্যয় করেছে সরকার। বাংলাদেশের এই দেনা ক্রমান্বয়ে বৃহৎ দানবের রূপ ধারণ করছে। বর্তমানে চীন, রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের কাছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার পায়। যেই ঋণ পরিশোধ করার সময় ২০২৪ সাল থেকে শুরু হয়ে যাবে। যেটা পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হবে। এই বৃহৎ একটা অংশ খরচ হয়েছে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোতে। কেননা, এই প্রকল্পের কাঁচামালের অধিকাংশই ঋণ ও আমদানি নির্ভর, তা ছাড়া সীমাহীন দুর্নীতি তো আছেই। এই প্রকল্পগুলোর ব্যয় যে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, সেটার কোনো জবাবদিহি নেই এবং এগুলোর বেশিরভাগ ব্যয়ই বিদ্যুৎ ও কয়লাক্ষেত্র থেকে আসা। এই অস্বচ্ছতাকে এড়াতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় আইন করেছে, যেটাকে দায়মুক্তির আইন বলা চলে। যেখানে বলা হয়েছে এই বিষয় সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই করা যাবে না, সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে গিয়ে যে এই প্রকল্পগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। যেমন আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান মেট্রোরেল। যেটার ব্যয়ভার বহন করতে সরকারকে অত্যধিক পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই প্রকল্পগুলো টেকসই হবে কি না, সেটা নিয়ে নানা সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া গত ১০ বছরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অপ্রয়োজনীয় বহু বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পেয়েছে এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব ব্যাংক অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণে জর্জরিত। কিন্তু এতকিছুর পরও এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে দেশের প্রায় অধিকাংশ ব্যাংককে পরিবারতন্ত্রের একটি সাধারণ চিত্র পরিদৃশ্যমান। যার ফলে এটা এখন আর খেলাপি ঋণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটা ভয়াবহ ব্যাংক জালিয়াতি হিসেবে দানব আকৃতি ধারণ করেছে। তা ছাড়া ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উন্নয়শীল দেশে রূপান্তরিত হবে। এতে করে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ধরনের অনুদান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
আইএমএফের শর্তগুলো আমরা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যাব এর শুভংকরের ফাঁকি সম্পর্কে। আইএমএফ স্যাপ তথা স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন শর্তারোপ করে। মালিকানার বেসরকারীকরণ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, সামাজিক নিরাপত্তাজনিত ভাতা বন্ধ করা, কৃষি-বিদ্যুৎ-জ্বালানির ওপর ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগ করাসহ নানাবিধ শর্ত। যেগুলো গরিব, মজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাভাবিক পথচলাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশকে দেওয়া আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা, খেলাপি ঋণ আদায়, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিক রূপদান, সরকারের ব্যয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ আরও অনেক শর্ত। আইএমএফের এই শর্তারোপে এক ধরনের নেতিবাচক বৈষম্য দৃশ্যমান। কেননা, আইএমএফ আবশ্যিকভাবে তীব্র চাপ প্রয়োগ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, সার, কৃষি খাতসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি বন্ধ করতে। এ ছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তামূলক খাতে সরকারের ব্যয় সম্পূর্ণ বন্ধকরাসহ আরও কয়েকটি শর্ত সরাসরি প্রয়োগ করতে বাধ্য করে আইএমএফ। অথচ অন্যান্য যে ঐচ্ছিক শর্তাবলি যেমন—খেলাপি ঋণ কমানো, সীমাহীন দুর্নীতি হ্রাসকরণ, সুশাসন, অর্থনৈতিক নানা সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ অন্যান্য নামমাত্র শর্ত আরোপ করা হয়। এই নামমাত্র শর্ত পূরণে কোনো দেশ ব্যর্থ হলেও আইএমএফ সে দেশে ঋণ দেওয়া অব্যাহত রাখে।
আইএমএফের ঋণ ও শর্ত দিয়ে কোনো দেশের সংকট দূর হয়েছে, এমন নজির খুবই কম। বাংলাদেশের চলমান সংকট দূর করতে দেশের নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে সুদৃঢ় ও পরিকল্পিত পরিবর্তন আনতে হবে। নতুবা আমরা এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ক্রমান্বয়ে নিপতিত হব।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়