প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ!

প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ!

দেশজুড়ে ভয়ংকর তাপপ্রবাহ চলছে। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় ৭২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে এ সপ্তাহে। রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার জন্য। তাপমাত্রার যে প্রবণতা, এ বছরই হয়তো নতুন রেকর্ড হবে। ভয়ংকর গরমে পশুকুল, প্রাণিকুলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। এর মধ্যে চলছে রোজা। এবারের রমজান শুরু হয়েছিল দারুণ আবহাওয়ায়। না গরম, না ঠান্ডা—দারুণ আরামদায়ক পরিস্থিতি। হঠাৎ সূর্য যেন ক্ষেপে উঠেছে। প্রচণ্ড গরমে রোজাদারদের কষ্ট হচ্ছে। তবে শতকষ্টেও তারা রোজা রাখছেন।

শুধু যে প্রচণ্ড গরম তাই নয়, গত কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতি উল্টাপাল্টা আচরণ করছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে দেখা নেই বৃষ্টির। প্রকৃতি কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করলেই আমরা সব দায় চাপিয়ে দিই প্রকৃতিরই ওপর। গালভরা নাম দিয়েছি ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’। কিন্তু প্রকৃতি কেন বদলে যাচ্ছে, এর দায় কার; সেটা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? এ ধরিত্রী কিন্তু শুধু মানুষের নয়। সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, মানুষসহ সব প্রাণিকুলের বসবাসের যোগ্য করে। সব পশু-প্রাণীর খাদ্য, বেঁচে থাকার উপায় বিরাজিত ছিল এ প্রকৃতিতেই। কিন্তু মাথায় একটু বেশি বুদ্ধি, এই দাপটে মানুষ পৃথিবীটা নিজেদের বানিয়ে ফেলেছে। মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থ বা সুবিধা বিবেচনা করেই বাকি প্রাণিকুলের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। পশুপাখির আবাসভূমি বন-জঙ্গল উজাড় করে মানুষ তার আবাস গড়েছে। এভাবে মনুষ্যকুল পৃথিবী গ্রাস করে নিয়েছে। প্রাণিকুল কোনোরকমে টিকে থাকা অল্প-স্বল্প জঙ্গলে লুকিয়ে বেঁচেছে বা চিড়িয়াখানায় ঠাঁই হয়েছে।

কিন্তু মানুষকে আমি বলি আত্মহত্যাপ্রবণ প্রাণী। তারা পৃথিবীর ভালোটা তো বোঝেই না, নিজেদের ভালোটাও বোঝে না। এই যে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বই ক্রমেই উষ্ণতর হয়ে উঠছে, এর দায় আমি পুরোটাই দিই মানুষকেই। প্রকৃতির একটা ভারসাম্য আছে, একটা সাইকেল আছে। কতটুকু পানি থাকবে, কতটুকু বরফ থাকবে, কতটুকু গাছ থাকবে, কতটুকু ফাঁকা জায়গা থাকবে—সবটুকুরই একটা হিসাব আছে। কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতির সব ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছি। আমরা যা করেছি, তা সব মানুষের জন্য করিনি। সম্পদশালীদের জন্য, প্রভাবশালীদের জন্য আরামদায়ক বিশ্ব গড়তে গিয়ে আমরা বেশিরভাগ মানুষের জন্য পৃথিবী বাসের অযোগ্য করে তুলছি। ধরুন আমরা, মানে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা গরম থেকে বাঁচার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেছি। তাতে পৃথিবী আরও উষ্ণ হয়েছে। অল্প কিছু মানুষের আয়েশের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষের বেঁচে থাকাটা কষ্টকর করে তুলেছি। শিল্পায়নের নামে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে প্রকৃতিকে উষ্ণতর করে তুলছি। আর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তার দায় দিচ্ছি প্রকৃতিকে। এখন আমরা ভয়ে আছি, পৃথিবী এভাবে গরম হতে থাকলে আরও বেশি বরফ গলে যাবে। তাতে হয়তো তলিয়ে যাবে অনেক দেশ। আমরা আশা করছি, গরিবদের দেশ তলিয়ে যাক, বড় লোকরা এসিতে আরামে হাওয়া খেতে পারবে। কিন্তু একবারও ভাবছি না, যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে; গোটা পৃথিবীই একসময় মরুভূমি হয়ে যাবে, কারোই বসবাসের যোগ্য থাকবে না।

গোটা বিশ্বের কথা বাদ দিন। ঢাকার কথায় আসি। নব্বইয়ের দশকে আমি দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করতাম। তখন জনকণ্ঠ অফিস ছিল মতিঝিলে। আর আমার বাসা ছিল রাজাবাজারে। রাতে কাজ শেষে অফিস থেকে তিন চাকার বেবিট্যাক্সিতে বাসায় ফিরতাম। গরমের সময় হাওয়া খেতে খেতে বাসায় ফিরতে খারাপ লাগত না। কিন্তু বেবিট্যাক্সি কাকরাইল মসজিদের মোড় ঘুরে মিন্টো রোডে ঢুকলেই শীতের একটা ঝাপটা লাগত। মতিঝিলের সঙ্গে মিন্টো রোডের তাপমাত্রায় অন্তত ৪ ডিগ্রির ফারাক থাকত। গাছ যে প্রকৃতিকে শীতল রাখে, পানি যে প্রকৃতিকে শীতল রাখে; এটা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানীর চেয়েও বেশি চালাক, আমাদের মাথায় টনটনে বাণিজ্য। গাছ কেটে আমরা ভবন বানিয়েছি, খাল ভরাট করে রাস্তা বানিয়েছি, জলাধার ভরাট করে আবাসিক এলাকা বানিয়েছি। ঢাকায় জমির কত দাম! এই মূল্যবান জমিতে গাছপালা, নদীনালা, পুকুর-জলাশয় লাভ কী? তার চেয়ে বড় বড় ভবন বানালে মোটা মোটা টাকা আসবে। সেখানে এসি লাগিয়ে আমরা আরামে হাওয়া খাব।

মতিঝিলে একসময় জলাধার ছিল। এখন সেখানে পানির দেখা পাওয়াই ভার। মতিঝিল, কারওয়ান বাজারে কয়টা গাছ আছে? ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, নিকেতন, জাপান গার্ডেন সিটি—বড় বড় আবাসিক এলাকায় কয়টা গাছ আছে, কয়টা জলাধার আছে? আমি যে মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ প্রজাতি বলি, সেটা কি আর সাধে। যেখানে আমরা থাকব, সেখানেও গাছ রাখি না, জলাধার রাখি না। রাস্তার পাশে কোনো গাছ নেই, রোড ডিভাইডারে কোনো গাছ নেই। ঢাকা ছিল সৃষ্টিকর্তার এক আশীর্বাদ। ঢাকার চারপাশে চমৎকার সব নদী ছিল—বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু। দখলে-দূষণে সেই নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। ঢাকা যে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত, সেই বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন অক্সিজেনের এতটাই অভাব, মাছও সেখানে বাঁচতে পারে না। বাণিজ্যের প্রয়োজনে আমরা মাকে হত্যা করতেও পিছপা হই না। ঢাকায় একসময় জালের মতো বিছানো খাল ছিল। এখন খালের অস্তিত্ব নেই, আছে কিছু নালা, তাও আবর্জনায় বন্ধপ্রায়।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার একটা ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতি। বাংলাদেশ সরকারের একটি পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে। মানুষ সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় হতো সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশে পরিবেশ মন্ত্রণালয় হলো দুধভাত। ‘শক্তিশালী’ মন্ত্রণালয়গুলো পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে পাত্তা না দিয়ে প্রাকৃতিক অরণ্য কেটে সেখানে ভবন বানায়, অফিস বানায়। মানুষকে আর সাধে আমি আত্মহত্যাপ্রবণ প্রজাতি বলি। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, শুধু মানুষ বোঝে না। আচ্ছা আপনার না হয় এসি কেনার সামর্থ্য আছে। আপনার সন্তান বা তার সন্তান বা তার সন্তানের তো এসি কেনার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। আপনি যে তার জন্য একটা উষ্ণ পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন, আপনার একটুও গ্লানি বোধ হয় না? যত অর্থই থাকুক আপনি গোটা শহরের, গোটা দেশের, গোটা বিশ্বের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।

বিশ্বকে বাঁচাতে হলে কী করতে হবে, সেটা কিন্তু আমরা ভালোই জানি। কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে, ক্লাইমেট চেঞ্জের ধকল সামলানো নিয়ে বছর বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করি আলোচনার নামে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করি না। প্রতিদিনই আমরা গাছ কাটছি, জলাধার ভরাট করছি এবং প্রকৃতি আরও উষ্ণ হচ্ছে।

এই যে এখন আমরা গরমে হাঁসফাঁস করছি, এর জন্য আমি মোটেই প্রকৃতিকে দায়ী করি না। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ। নির্মম প্রতিশোধ। আপনি নদীর স্রোত আটকে দেবেন, গাছপালা কেটে ফেলবেন, পাহাড়-টিলা সমান করে ফেলবেন; প্রকৃতি চেয়ে চেয়ে দেখবে? আপনি যা করবেন, প্রকৃতি তা ফিরিয়ে দেবে। আপনি একটা গাছ কাটলে প্রকৃতি আরও গরম হবে। আপনি একটা গাছ লাগালে প্রকৃতি আরও শীতল হবে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।

নেটিভ আমেরিকান একটি প্রবাদ আছে—‘যখন শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি খেয়ে ফেলা হবে, শেষ জলাধারটি বিষাক্ত হবে, তখন বুঝবে টাকা খাওয়া যায় না।’

সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ কি আদৌ নিজেদের ভালোটা কখনো বুঝবে। সে কি বুঝবে, টাকা আসলে খাওয়া যায় না।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জেলেনস্কিকে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রে’ সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার পোল্যান্ড নাগরিক

ক্ষেতে কাজ করার সময় হিটস্ট্রোকে কৃষকের মৃত্যু

পার্কে ডেকে তরুণীকে খুন, যেভাবে বদলা নিলেন মা

শেষ ওভারে ধোনির অবিশ্বাস্য কীর্তি

প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা

আনোয়ার সিমেন্টে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকা

মৌয়ালকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল বাঘ

এসআইকে পিটিয়ে মাথা ফাটানোয় গ্রেপ্তার ১৬

লন্ডন মাতাতে যাবেন জেমস

লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

১০

মার্কিন সংগীতশিল্পীর রহস্যজনক মৃত্যু 

১১

সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য : রিজভী 

১২

বিবর্ণ মোস্তাফিজে হতাশ বিশেষজ্ঞরা

১৩

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নেবে সীমান্ত ব্যাংক, ৪০ বছরেও আবেদন

১৪

আ.লীগের সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ : ওবায়দুল কাদের

১৫

মন্দিরে পূজা দিয়ে ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত

১৬

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই ৩ বিভাগে সুসংবাদ

১৭

শিবনারায়ণ দাসের প্রতি সর্বস্তরের শ্রদ্ধা

১৮

সাবমেরিন ক্যাবল বন্ধ, ইন্টারনেট স্বাভাবিক হবে কবে

১৯

বুয়েট : সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও কিছু প্রশ্ন

২০
*/ ?>
X