শেখ হাসিনা: ডু অ্যান্ড ডান

মোস্তফা কামাল।
মোস্তফা কামাল।ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্র আপনাকে কেন আর ক্ষমতায় চায় না?—জবাব, যারা আমার পরিবারকে হত্যা করেছে, এমনকি ১০ বছরের ভাইকে হত্যা করেছে, সেই ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক। প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির। আর জবাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের সাপ্লিমেন্টারি প্রশ্ন ছিল এটি। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আর আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চায় না, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে বিভিন্ন দেশে কাউকে ক্ষমতায় আনতে পারে, নামাতেও পারে—শেখ হাসিনার এ ধরনের কিছু সোজাসাপ্টা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছিল প্রশ্নটি। তিনি জবাবও দিয়েছেন সেই দৃষ্টে।

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য—তিন দেশ সফর শেষে দেশে ফিরে প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনেও তার কথার রেশ-তেজ ছিল ওই রকমই। ‘কথা নাই বার্তা নাই, স্যাংশনের ভয় দেখাবে, আর আমরা ভয়ে মুখ বুজে থাকব কেন?—যুক্তরাষ্ট্রকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। স্যাংশন দেওয়া দেশ থেকে আর কিছু কেনাকাটা করা হবে না ঘোষণাটি আবার উল্লেখ করেন সংবাদ সম্মেলনে। রাজনীতিক এবং ঝানু কূটনীতিকদের জন্য আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এমন দুঃসাহসী কথাগুলো। বিশ্বব্যাপী স্নায়ুচাপের এক কঠিন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্করের এমন সাহস রাজধানীর পল্টন ময়দানের বক্তব্যের সঙ্গে তুলনার মতো নয়। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বমানচিত্রে নিজের একটা অবস্থান এরই মধ্যে তৈরি করে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত নিউজ আইটেম হচ্ছেন গত কদিন ধরে। বিশেষ করে বিবিসির সাক্ষাৎকারে একপর্যায়ে বলে ফেলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। স্কুল, শপিংমল, রেস্তোরাঁয় পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া। প্রধানমন্ত্রী বাতকেবাত কথাগুলো বলে ফেলেছেন বা এ ধরনের কথার সুফল-কুফল তিনি জানে না—তা ভাবার কারণ নেই। একইভাবে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশেষ সুবিধা তুলে নিলে কী হতে পারে, তাও তিনি বোঝেন না—ভাবা যায় না। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঢেউ। সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের গণ্ডগোলে বগল বাজাচ্ছে বিএনপি। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সফরে প্রধানমন্ত্রী প্রটোকল না পাওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে এখন ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের প্রটোকল তুলে নিচ্ছে—এমন একটি প্রচারণা চলছে বিএনপি থেকে। এ সরকার ক্ষমতায় আছে আর মাত্র দু-তিন মাস—এমন প্রচারণাও আছে তাদের। কোত্থেকে, কোন শক্তিতে তাদের এমন বার্তা? জাতীয় নির্বাচন কি দু-তিন মাস পরই? যে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ? অথবা বিএনপির আন্দোলন এত তেজোদীপ্ত, যার তাপে-চাপে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালাবে?—এসব জিজ্ঞাসা এড়িয়ে দলটির কয়েক নেতার চলনে-বলনে বিজয়ীভাব। বিএনপি মহাসচিব কোনো দিন তারিখ উল্লেখ না করে বলেছেন, হাতে সময় খুব কম। এ সময়ের মধ্যে সরকার দ্রুত সেফ এক্সিট না নিলে পরে পালানোর পথও পাবে না। অন্যদিকে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের মনোভাব অনেকটা একরোখা। কারও হাতে ক্ষমতা দিয়ে সরে পড়া বা সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার মতো কাজ না করার সিদ্ধান্তে অটল প্রধানমন্ত্রী। পরিষ্কারভাবে এ বার্তা জানিয়েছেন দেশ-বিদেশ সব জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো সুপার পাওয়ার দেশ সফরের সময় তা বলে এসেছেন। দেশে ফিরে প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনে তার অবস্থান আরও পরিষ্কার করেছেন। মোটকথা, বলার আর কিছু বাকি রাখেননি। সরকারের সক্ষমতা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি-কূটনীতির প্রোফাইল বিএনপি জানে। বিদেশিদেরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর বেলায় শেখ হাসিনা ঝুঁকি নিয়ে সফল হয়েছিলেন, এবার তিনি আরও বড় ঝুঁকি নিয়ে সফল হতে চান। বাকিটা অনিবার্য বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকের সংজ্ঞা-ব্যাখ্যা একেবারেই তাদের নিজেদের মতো। তারা তবে, যদি, কিন্তু দিয়ে বাক্য তৈরি করে। যেমন—নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ‘তবে’যুক্ত বাক্যের প্রতিটি শব্দ নানান অর্থে ভরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের একশব্দে অনেক অর্থ। তারা কখন কোনটাকে আসল মনে করে, বোঝা কঠিন। কখন কোনটা অভ্যন্তরীণ আর কখন আন্তর্জাতিক, বলা শক্ত। এমন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই দুঃসাহসে শুধু সামনে এগোচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পিছু হটার রেকর্ড নেই। যেখানে আছেন, সেখানে থিতু থাকার চর্চাও নেই। উদ্বেগজনক-শঙ্কাজনক পরিস্থিতি পার করেছেন, করতেই থাকবেন—এমন একটি মিথ তৈরি হয়েছে। এর আগে, করোনা মহামারির মধ্যে এবং পরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশ নিয়ে, তাকে নিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্বেগের অনেক আভাস ছিল। ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ, উন্নত বিশ্বের প্রয়োজনীয় সহায়তা না পেলে দেউলিয়া হবে এসব দেশ। এ ধরনের কুলক্ষণে বার্তার মাঝে তার সাহসী উচ্চারণ ছিল: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষ হলেও বাংলাদেশে হবে না। এখন পর্যন্ত তার সাহসী উচ্চারণ বাস্তবে ফলবান।

বিশ্বমন্দার তাপ যেন বাংলাদেশে কম পড়ে, সেজন্য সতর্কবার্তার সঙ্গে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো ও মিতব্যয়ী-সাশ্রয়ী-সঞ্চয়ী হওয়ার আহ্বান ছিল তার। আর নির্দেশনা হিসেবে প্রশাসনকে বলেছেন, ঘুরে ঘুরে অনাবাদি জমি শনাক্ত করে সেগুলোকে চাষের আওতায় আনতে। এক ইঞ্চি জমিও যেন পরিত্যক্ত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য, পরামর্শ ও নির্দেশনা মেশানো এ প্যাকেজের কিছু ফল এরই মধ্যে মিলতে শুরু করেছে। এর বিপরীতে গুঞ্জন-গুজবও চলেছে। ‘ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি’, ‘লবণ-চিনি’, ‘চুয়াত্তরের বাসন্তী’ নাটক রিমেক করার কদাকার প্রযোজনাও হয়েছে। এরও আগে কিছুদিন চলেছে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করার ঢোলে বাড়ি। গজবের মতো চাউর করা ওই গুজবে কুলাতে না পেরে রটানো হয়েছে দেশে বহু মানুষের না খেয়ে মরার ভয় জাগানিয়া তথ্য। নামজাদা কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ-গবেষক-বিশ্লেষকও শামিল এ নোংরা দৌড়ে। রিজার্ভ নিয়ে যাচ্ছেতাই কথামালা চালিয়েছেন তারা। আশা না জাগিয়ে মানুষকে করেছেন শঙ্কিত। আইএমএফ থেকে সরকার কেন ঋণ পায় না, আবার ঋণ পাওয়ার পর বলা হয়েছে, সরকার কেন আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়? বৈশ্বিক বা স্থানিক কারণে কোনো দেশে অর্থনীতির চাপ কেউ একা ভোগে না। তাই বলা হয়ে থাকে মহামারি, আগুন, দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগ বরাবরই নিরপেক্ষ। ধনী-গরিব সবাইকে এক চোখে দেখে। কাউকে ছাড় দেয় না। লোকালয়-দেবালয় ভেদাভেদ করে না। প্রাণঘাতী মহামারির পর এখন বিশ্বমন্দায় খাদ্যাভাবেও তা প্রমাণিত। করোনা নামের বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে ও পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হানা দিয়েছে। এর পরপরই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বমন্দার চোখ রাঙানি। নিত্যপণ্যের দাম চড়া। আয়-ব্যয়ের হিসাবে অমিল। মানুষের কষ্টের বিপরীতে জীবন বাঁচানোর সঙ্গে উন্নয়ন চলমান রাখা ও অর্থনীতি টেকানোর চ্যালেঞ্জ। এ প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা ও আহ্বান জড়ানো কিছু নির্দেশনা ছিল এবং আছে। তার সতর্কতা ও নির্দেশনার মাঝে ফাঁক থাকলে ধরিয়ে দেওয়া যায়। গঠনমূলক সমালোচনাও উপকারে আসে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নানা সূচক ও সমস্যা নিয়ে সমালোচনাও সুফল দিতে পারত। দেশি-বিদেশি কোনো মন্দ চর্চায় পিছু হটার সুযোগ নেই শেখ হাসিনার। নিজেকে ওই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। চ্যালেঞ্জ জয় করতেই হয় তাকে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক বহু চ্যালেঞ্জ জিতে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক হয়ে গ্লোবাল রাজনীতির মাঠে। বিশ্ব পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রকেও ছেড়ে কথা না বলার পর্যায়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বোন শেখ রেহানাসহ বিদেশ থাকায় বেঁচে যান তিনি। ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপনের পর দেশে ফিরে শুধু সামনে এগোতেই শিখেছেন। আন্দোলন, সংগ্রাম, কারাবরণ, হয়রানি, এমন কি হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন বারবার। কিন্তু দমেননি। থামেননি। এবারের অবস্থাটা আরেকটু ভিন্ন। সন্ধিক্ষণ যাকে বলে। এর মধ্যেও বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় তার। দৃঢ়প্রত্যয়, মাথা নত না করা এবং রাজনীতির মাঠে কৌশলে পরিস্থিতি উতরানোর একটি ম্যারাডোনা-মেসি স্টাইল তিনি তৈরি করেছেন। নিজের তৈরি করা স্টাইল নিজেরই চর্চার সামর্থ্য যেন শুধু তারই। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিশ্বব্যাংক বা যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বড় বড় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে জেতার রেকর্ডও তারই। যা তাকে বিশ্বনেতৃত্বের কারও কারও খুব পাশে বা দূরে নিয়ে গেছে, যা তার জন্য সম্ভাবনার, আবার শঙ্কারও।

লেখক: কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com