বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৮:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নূরে আলম সিদ্দিকী ও আজকের ছাত্ররাজনীতি

নূরে আলম সিদ্দিকী ও আজকের ছাত্ররাজনীতি

আরও এক খলিফা বিদায় নিলেন। পরপারে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী। গতকাল বুধবার ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত উপাধি। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর এ কথার ব্যবহার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া সেই চারজন হলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও নূরে আলম সিদ্দিকী। প্রথমজন তথা ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন বেশ আগেই মারা গেছেন। গতকাল চলে গেলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। আগেই গেছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। বেঁচে আছেন জাসদ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আ স ম রব, যিনি এখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

কে এর ব্যবহার শুরু করল, কেন করল—এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। তবে নূরে আলম সিদ্দিকী নিজে একবার একটি পত্রিকাকে বলেছিলেন, এ কথা সর্বজনবিদিত এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত—সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরপরই বাংলার মানুষ আমাদের চার খলিফা বলে অভিহিত করে। কে, কেন, কীভাবে এই খলিফা শব্দটি উদ্ভাবন করে আমাদের নামের বিপরীতে ব্যবহার শুরু করে, সেটি আজও আমার কাছে সত্যিকার অর্থে অজানা। যে-ই এটি উদ্ভাবন করুক না কেন, এটা সারা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যোদয়ের মতো শুধু ছড়িয়ে পড়েইনি, সবার হৃদয়কে বিস্ময়করভাবে আপ্লুত করে এবং নিমেষেই এ খলিফা নামটি সবার মুখে এমনকি সংবাদমাধ্যমে উচ্চারিত ও প্রচারিত হতে থাকে।

নূরে আলম সিদ্দিকী আর নেই, আসলে রাজনীতিতে ছিলেনও না অনেক দিন। তিনি ১৯৪০ সালের ২৬ মে ঝিনাইদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সত্তরের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৭০-৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছয় দফা আন্দোলন, অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন যশোর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে অংশ নিয়েছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতার পর নানা মান-অভিমান নিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। নূরে আলম সিদ্দিকী বর্তমানে রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

চার খলিফা ছিলেন একেকটি নক্ষত্র। তারা সবাই ছাত্রলীগ করতেন। পরে বিভিন্ন কারণে এক-একটি নক্ষত্র একেক দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাদের প্রসঙ্গ এলেই উঠে আসে স্বাধীনতার আগের সময়ের ছাত্র আন্দোলনের কথা। তখনকার দেশের প্রাণকেন্দ্র ডাকসুর মাধ্যমে পুরো দেশের ছাত্র-জনতাকে এক করে আন্দোলন করেছেন এ নেতারা। তাদের মুখের দিকে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশ, দেশের ছাত্রসমাজ তাকিয়ে থাকত কী কর্মসূচি আসছে।

নূরে আলম সিদ্দিকী প্রায় সময়ই ছাত্ররাজনীতির বর্তমান হাল দেখে বেদনাহত হতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে চরম হতাশ ছিলেন তিনি। একবার একটি পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুটি বিভাজিত অংশের মধ্যে যে প্রতিহিংসার তাণ্ডবলীলা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে) ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাসহ হিংস্র ঘটনা ঘটেছে সেটি শুধু আমাদের জন্য অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অকল্পনীয়ই নয়—আমি কেন, ষাটের দশকের সব নেতৃত্বের হৃদয়ে তা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির একটা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এ দেশের মানুষ সেটা গর্বের সঙ্গে স্মরণও করে। ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বড় রাজনীতিবিদরা বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এখন মানুষ রীতিমতো বিরক্ত ও মর্মাহত ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে। ছাত্ররাজনীতি আসলে এখন আর প্রকৃত রাজনীতিবিদ তৈরি করতে পারছে না।

এমন এক দিনে ষাট ও সত্তরের দশকের ডাকসাইটে নূরে আলম সিদ্দিকীকে স্মরণ করতে হচ্ছে যখন এ দেশের ছাত্ররাজনীতি থেকে আন্দোলন বস্তুটিই উধাও হয়ে গেছে। এখন যা আছে, তা হলো ক্যাম্পাস, হল ও কলেজ দখলদারির জন্য পেশিশক্তির প্রয়োগ। এখন ছাত্ররাজনীতি করা ছেলেদের নামে শুনতে হয় এরা গ্যাং তৈরি করে, ছিনতাই করে, ধর্ষণ করে, চাঁদাবাজি করে, মনোনয়নবাণিজ্য করে, পদবাণিজ্য করে। এখন ছাত্র-সমাজবিরোধী-নেতা সব মিলেমিশে একাকার। সম্প্রতি দেখা গেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নেতা তার দুই পাতি নেতাকে দিয়ে পা টেপাচ্ছেন। তিনি নাকি আবার দশ বছর ধরে পদ দখল করে আছেন। এগুলো একসময় কল্পনায়ও আনা যেত না।

স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে বাম বা দক্ষিণপন্থি যে যেমন রাজনীতিই করুক, তার মধ্যে একটা আদর্শ ছিল। এখন যা হচ্ছে, সেটা সার্বিক অবক্ষয়। অনেকে এটাও বলেন যে, শিক্ষাব্যবস্থাটাই ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, তেমনই হাল ছাত্ররাজনীতির।

নূরে আলম সিদ্দিকীরা ডাকসু নেতা হয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে। বাংলাদেশে ২৯ বছর পর একটা ডাকসু নির্বাচন হলেও সেটা বিতর্কিত নির্বাচন। নির্বাচিত সংসদপড়ুয়াদের সুবিধা-অসুবিধা দেখে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে। ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের। এদের পেছনে আবার মদদদাতা অনেক প্রাক্তন ছাত্রনেতা। ফলে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়েছে সার্বিকভাবে। এমন পরিস্থিতিতে পেশিশক্তি তথা ক্ষমতা সবাইকে অনুগত বলেই ধরে নেয় এবং তাই হচ্ছে।

আলো দেখাতে পারছে না ছাত্ররাজনীতি। প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি এখন কোণঠাসা। পৃথিবীর বহু দেশেই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, সবেই নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররাজনীতি। মানুষের দাবির সঙ্গে ছাত্ররা এগিয়ে এলে সবকিছুতেই ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। এ দেশে ছাত্ররাজনীতির এ ভূমিকার অবনতি ঘটেছে। ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ভাষা নতুন বয়ান তৈরি হয়নি, যতক্ষণ না সে লড়াই প্রগতিশীল চরিত্র পেয়েছে বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়েছে। এমন অবক্ষয়ের সময়ে নূরে আলম সিদ্দিকীকে স্মরণ করে প্রত্যাশা করছি আলো আসুক ছাত্ররাজনীতিতে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুদের ওপর কর অব্যাহতি পেল অফশোর ব্যাংকিং

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বাচসাস’র নিন্দা

চবিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রী থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ

সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ায় শাহবাগ থানায় জিডি

পদ্মা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

আদাবরে স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক

ভর্তি পরীক্ষায় জবিতে থাকবে ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক

অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, বিপাকে পুলিশ কনস্টেবল

গরমে বেড়েছে ডায়রিয়া, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৮৩

১০

একাধিক অন্তরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল, কে এই তরুণী

১১

‘পরকীয়ার জেরে’ হত্যা করা হয় মিতুকে : মা

১২

গাজার সেই শহরে আবারও নারকীয় হামলার ঘোষণা

১৩

রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদে 

১৪

যেসব জেলায় শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা

১৫

‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার’

১৬

গাজীপুরে তীব্র দাবদাহে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ

১৭

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আরও একজনের নাম যুক্ত হচ্ছে

১৮

বিআরটিএ’র অভিযানে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা 

১৯

ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়নি : রেলমন্ত্রী

২০
*/ ?>
X