ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভুলে যাওয়া এক অভিশপ্ত দিন

ভুলে যাওয়া এক অভিশপ্ত দিন

গতকাল ছিল ৩১ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত আরও একটি কলঙ্কিত দিন। ঘটনাবহুল অনেক সালতামামির কাছে ভুলে যাওয়া এক অভিশপ্ত দিন—স্বাধীন বাংলাদেশের এক নিকশ কালো ইতিহাস। আজ থেকে ২৭ বছর আগে ১৯৯৬ সালের এই দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাবেক মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিন চৌধুরীর সরাসরি নির্দেশে প্রায় ৭০০ পুলিশ আর বিডিআর জওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের নিরীহ ছাত্রদের ওপর পৈচাশিক নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। এই ঘটনায় আহত হন ২ শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক এবং গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক ছাত্র ও কর্মচারীকে। আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্বের শিকার হন। সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের বিবরণ অনুযায়ী ‘নজিরবিহীন এই সশস্ত্র হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক অকল্পনীয়, অমানবিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পুলিশ গেট ভাঙ্গিয়া জগন্নাথ হলে প্রবেশ করিয়া প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালায় এবং রাইফেলের বাঁট ও বুটের আঘাতে ছাত্রদের রক্তাক্ত করিয়া ফেলে। মধ্যযুগীয় কায়দায় পুলিশের এই বর্বরোচিত হামলার দৃশ্য যাহারা দেখিয়াছে, তাহারাই শিহরিত হইয়া উঠিয়াছেন। উপস্থিত সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইহা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেও ছাড়িয়া গিয়াছে।’

তৎকালীন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা উদ্বোধন করতে আসার কথা। তখন বিএনপি সরকারের চরম দুঃশাসনের কারণে ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় খালেদা জিয়াকে যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিশাল মিছিল বাংলা একাডেমির মূল ফটকে যাওয়া মাত্র শত শত পুলিশ গুলি, লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বিচারে বেধড়ক পেটাতে পেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে নিয়ে আসে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশী, শামসুন্নাহার হল ও শহীদ মিনার চত্বরের দিক থেকে পুলিশ জগন্নাথ হল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। দুপুরের পর জগন্নাথ হলে শুরু হয় পুলিশের নির্মম অ্যাকশন। ৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশ জগন্নাথ হলের প্রতিটি রুম এবং হল ক্যান্টিনে গিয়ে বিনা উসকানিতে ছাত্রদের বেদম প্রহার শুরু করে। এমনকি যেসব সাধারণ ছাত্র পড়ালেখায় ব্যস্ত ছিলেন ও দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন, তারাও পুলিশের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি। পুলিশ হলের ডাইনিং রুমে ঢুকে লাথি দিয়ে ভাত ও ডালের গামলা ফেলে দেয়। জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে কম্বল জড়িয়ে দম বন্ধ অবস্থায় বেদম প্রহার করে, চ্যাংদোলা করে রুম থেকে বারান্দায় ফেলে দেয়। এই হামলার সবচেয়ে বিভৎস দিক ছিল পুলিশ বাহিনীর অশ্রাব্য ও সাম্প্রদায়িক গালাগাল, যা অতীতের সব হামলার নৃশংসতাকে ম্লান করে দেয়। এমনকি কোনো কোনো ছাত্রদের রুমে রক্ষিত দেব-দেবীর ছবি ও প্রতিমাও রক্ষা পায়নি। সেদিন দেশি-বিদেশি সব গণমাধ্যমে এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম হিসেবে ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ঘটনার প্রতিবাদে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা একযোগে পদত্যাগ করেন। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে আক্রমণ করেন।

ঘটনার পরপর হাসপাতালে আহতদের দেখতে ছুটে যান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তিনি আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘জগন্নাথ হলের ছাত্রদের ওপর এই হামলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়, শিক্ষাঙ্গনে এই রক্তপাত জাতির বিবেককে আঘাত হানিয়াছে, এ জন্য খালেদা জিয়াকে ইতিহাস ক্ষমা করিবে না।’ ঘটনার দুদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে পালিত হয় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। এ হামলা ছিল মূলত তৎকালীন বিএনপি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় সাম্প্রদায়িক নীতির প্রতিফলন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সহ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত আবাসিক হল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই হলেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর শুরুতেই জগন্নাথ হলের ঘুমন্ত ছাত্র-শিক্ষকদের নৃশংসভাবে হত্যা করে । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে জগন্নাথ হল বারবার সাম্প্রদায়িক সরকারের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আবেদ খান ‘মন জয় করার বদলে যুদ্ধ জয় করলেন প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে ২১ বছরে জগন্নাথ হলের ওপর পুলিশ ও সরকারের পেটোয়াবাহিনীর হামলা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ বার।’

১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি নৃশংস এই হামলার সময়ে আমি জগন্নাথ হলের একজন আবাসিক ছাত্র। ঘটনার দিন দুই দুইবার পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সপ্তাহখানেক চিকিৎসাধীন ছিলাম। সেদিন বিএনপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক সরকারের নির্মম আক্রোশ আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৯৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে সুলতান নাহার লিখেছিলেন, ‘তৎকালীন বিএনপি সরকারের সুপরিকল্পিত নির্মম পুলিশি হামলা নৃশংসতা ও ব্যাপকতা শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর হামলারই তুল্য। একটি স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক (!) সরকারের অধীনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কোনো সুস্থ মানুষ বা সভ্যসমাজ মেনে নিতে পারে না।’ ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী কলম ধরলেন এবং লিখলেন ‘এ কোন বাংলাদেশ?’।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরও বিএনপি-জামায়াত অপশক্তির এ ধরনের সংঘটিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত বর্বর হামলা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে। নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের মন্ত্রী-এমপিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তাদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। সেই হামলার প্রধান টার্গেট ছিল দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

আজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অসাম্প্রদায়িক নীতি বাস্তায়নের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়–বাংলাদেশ যেন আর সেই উগ্র-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার না হয়। আমরা যেন আর ফিরে না যাই সেই দুঃসময়ের নির্মম অভিঘাতে।

লেখক : দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভুটান ভ্রমণে সুখবর মিলতে পারে বাংলাদেশিদের

‘চলতি বছরের শেষ নাগাদ হেরে যেতে পারে ইউক্রেন’

কালবেলা অনুসন্ধান পর্ব-১ / জনপ্রতিনিধি ও নেতারাই ছিল লামিয়ার মূল টার্গেট

নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডার বেসরকারি খাতে দেওয়ার প্রতিবাদ

দলের বিদায়ে কানসেলোর পরিবারের মৃত্যু কামনা বার্সা সমর্থকদের

যে ভুল হিসাব-নিকাশে ডুবছে ইরান-ইসরায়েল

দুই জেলায় হিটস্ট্রোকে ৩ জনের মৃত্যু

মাদ্রাসার কাছে বিক্রি হলো সিনেমা হল

ভালোবাসার অর্থনীতি

বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দেবে ঢাকা বিআরটি

১০

ড্রেনে বোতল-পলিথিন না ফেলতে যুবকদের সচেতনতা

১১

শসার মণ ১শ টাকা, লোকসানে চাষিরা

১২

বাজেটে ইন্টেরিয়র সেক্টর: আমাদের প্রত্যাশা

১৩

শিল্পী ধ্রুব এষকে বিএসএমইউতে ভর্তি

১৪

এফএ কাপের সেমিফাইনালে হলান্ডের খেলা নিয়ে সংশয়

১৫

চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে

১৬

নিত্যপণ্যের তুলনায় তামাকপণ্য সস্তা, দাম বাড়ানোর দাবি

১৭

মোটরসাইকেল সড়কের বড় উপদ্রব : ওবায়দুল কাদের

১৮

ভোলায় পুকুরে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

১৯

দেশের বাজারে কমলো সোনার দাম

২০
*/ ?>
X