জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ : কাশীকান্ত মৈত্র

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ : কাশীকান্ত মৈত্র

একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিন। গোটা ভারতের লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হন ‘মানবিক বোধ’-এর টানে। আবার অনেকের মধ্যে ছিল মাটি ও শেকড়ের টান। এবারের বিজয়ের মাসে তাদের নিয়েই ‘কালবেলা’র বিশেষ আয়োজন। আজ খ্যাতিমান রাজনীতিক ও আইনজীবী কাশীকান্ত মৈত্রের কথা লিখেছেন জাকির হোসেন

কাশীকান্ত মৈত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। কাশীকান্ত মৈত্র ’৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য ও দুগ্ধ সরবরাহমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির (বিদ্রোহী) নেতা। ’৬২ থেকে ’৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিধানসভার সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ তার জন্মভূমি। সেই টান থেকে সেদিন তিনি বাংলাদেশকে আরও গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে ছিল নিজের জন্মভূমির মুক্তির লড়াই। জন্মভূমির মুক্তির সংগ্রামে ওই সময় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনকার পরিকল্পিত গণহত্যাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই বারবার সভা-সমিতি ও বিধানসভায় ধিক্কার জানিয়েছেন।

একাত্তরের ৩ জুলাইর ভেনেজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত ক্যাথলিকদের দৈনিক পত্রিকা Religion-এর বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয় তাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। ওই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ড হিটলারের এক্সারমিনেশন ক্যাম্প, তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের হত্যাকাণ্ডকেও ছাড়িয়েছিল। ছাড়িয়েছিল কঙ্গো, ভিয়েতনাম ও হাঙ্গেরির ট্র্যাজেডিকেও। বাংলাদেশের কৃতী সন্তান, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও যুবকদের হত্যা করা হয়েছিল ইঁদুরের ন্যায়। কাশীকান্ত মৈত্র তার ‘রাজনীতি, বিপ্লব কূটনীতি’ গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, ‘এখনো স্পষ্ট মনে আছে ৭১-এর ৭ মে শুক্রবারের কথা। ওইদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব ওঠে। আমি তখন বিধানসভার সদস্য। মুখ্যমন্ত্রী বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি তোলেন অবিলম্বে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অস্ত্র প্রদানের বিধানসভায় এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক হয়। বিতর্কে আমিও অংশ নিই। আমিও সেদিন জোরালোভাবে সমর্থন জানাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। যদিও সেদিন দু-একটি রাজনৈতিক দল ওই সমর্থনের প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখিয়েছিলেন। তবু বিধানসভায় বাংলাদেশের সমর্থনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এমনকি বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামকেও সেদিন সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। রাজ্য বিধানসভায় সেদিনকার সিদ্ধান্ত ৮ মে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় সবিস্তারে ছাপা হয়েছিল।’

কাশীকান্ত মৈত্র জানান, সেদিন বাংলাদেশের শহীদদের স্মরণে বিধানসভায় দুই মিনিট মৌনতাও পালন করা হয়। বিধানসভায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। ওই সভায় আরও দাবি করা হয়, সীমান্ত এলাকায় পাঁচ লাখ শরণার্থীর অবিলম্বে পুনর্বাসন দেওয়ার। এমনকি শরণার্থীদের জন্য রাজ্যে পুনর্বাসন ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়।

অ্যাডভোকেট কাশীকান্ত মৈত্রের জন্ম পাবনা শহরে। ১৯৭৭ সালে তিনি জনতা পার্টিতে যোগ দেন। লিখেছেন বেশকটি মূল্যবান গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ক. মার্কসবাদ লেনিনবাদ : তত্ত্বে ও প্রয়োগে, খ. রাজনীতি, বিপ্লব কূটনীতি, গ. গণতন্ত্র : মুখোশ ও মুখশ্রী, ঘ. মার্কসবাদ : কৃষক ও কৃষিনীতি, ঙ. মার্কস ও সমাজতন্ত্র ও চ. Socialism. Legality & Liberty ইত্যাদি।

পারিবারিক সূত্রেই রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল কাশীকান্ত মৈত্রের। তার বাবা লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ছিলেন স্বাধীনতার প্রাক-পর্বে গণপরিষদের সদস্য। পরবর্তীকালে কৃষ্ণনগর থেকে তিনি লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। পুত্র কাশীকান্তের রাজ্য বিধানসভায় প্রবেশ সেই কৃষ্ণনগর থেকেই। প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির (পিএসপি) হয়ে ১৯৬২ সালে তার প্রথমবার বিধানসভায় যাওয়া কৃষ্ণনগর পূর্ব কেন্দ্র থেকে। এর পর ১৯৬৭ ও ’৬৯ সালে দুবার বিধায়ক হন সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির (এসএসপি) টিকিটে। এসএসপি তৈরি হয়েছিল পিএসপি ভেঙেই। কৃষ্ণনগর পূর্ব কেন্দ্র থেকেই ১৯৭১ সালে কাশীকান্ত মৈত্র ছিলেন নির্দলীয় প্রার্থী। সেবার তিনি জয়লাভ করেন কংগ্রেসের সমর্থনে। পরের বছর, ১৯৭২ সালে কাশীকান্ত মৈত্র কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচিত হন এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় খাদ্য ও পশুপালনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। একটি কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় তদন্তে তার আপ্ত-সহায়কের নাম জড়ানোয় তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। নৈতিক অবস্থান নিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ানোর ওই সিদ্ধান্তকে এখনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবেই মনে রেখেছেন বঙ্গ রাজনীতির পুরোনো চরিত্ররা।

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার পর কংগ্রেসের সঙ্গে আর তেমন সংস্রব রাখেননি কাশীকান্ত মৈত্র। পরে ১৯৭৭ সালে আরও একবার তিনি বিধায়ক হয়েছিলেন, সেবার জনতা পার্টির প্রার্থী হয়ে। বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে নাটকীয় উপাদানও ছিল। আশির দশকের গোড়ায় বিধানসভা ভোটে প্রার্থী কাশীকান্ত মৈত্র একবার হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান। তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগে বিস্তর হৈচৈ পড়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ পর প্রত্যাবর্তন ঘটে তার। ‘অপহরণে’র সঙ্গে ‘নকশাল যোগে’র অভিযোগ ছিল কাশীকান্ত মৈত্রের তরফে। মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ প্রবীণ এ আইনজীবী ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপজেলা ও সংসদ উপনির্বাচনকে সামনে রেখে ফের উত্তপ্ত শৈলকুপা

হিটস্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

চাঁদা না পেয়ে ছাত্রলীগ নেতাকে বেধড়ক পিটুনি

সাংবাদিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি মামলা

স্ত্রীর দাবি, সালমান শাহ-শাকিবের মতোই এবার টার্গেট জয়

প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু, গুরুতর অপরাধে লঘু মামলা হয়েছে

বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয় : পাক প্রধানমন্ত্রী

শাহজাদপুরে বৃষ্টি কামনায় ইসতেসকার নামাজ আদায়

চুয়েটে উপাচার্য অবরুদ্ধ, হল না ছাড়ার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের

শিশু ধর্ষণের অভিযোগে ৬০ বছরের বৃদ্ধ গ্রেপ্তার

১০

নাভালনির শেষকৃত্য করা সেই পুরোহিতকে চরম শাস্তি

১১

চরমোনাই পীরের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা 

১২

গাজীপুর ওয়ালটন এসি কিনে মিলেনিয়র হলেন স্যানিটারি ব্যবসায়ী

১৩

শূন্য রানে ৭ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড

১৪

ইরান-ইসরায়েল সংকট ও মধ্যপ্রাচ্যের নয়া ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ

১৫

রাজশাহীতে তীব্র তাপদাহে হাঁসফাঁস অবস্থা

১৬

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারকে অস্থিতিশীল করছে যুক্তরাজ্য : অ্যামনেস্টি

১৭

ফেরত পাঠানো হলো মিয়ানমারের ২৮৮ সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্যকে

১৮

অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার পদে ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি

১৯

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভালো কিছুর সম্ভাবনা দেখছেন সাকিব

২০
*/ ?>
X