মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত বিশাল ভূখণ্ড ও বিস্তৃত সমুদ্রসীমা বিশিষ্ট মুসলমান অধ্যুষিত দেশ সালতানাত অব ওমান। ১৯৭০ সালে বাবা শেখ সাঈদ বিন তৈমুরকে সরিয়ে তার পুত্র সুলতান কাবুজ বিন সাঈদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ৫০ বছর দেশ শাসন করেন। এরই মধ্যে ২০০১ সালে নিজ শাসনের ৩০তম বার্ষিকী পালনের উদ্দেশে তিনি নির্মাণ করেন সুলতান কাবুজ গ্র্যান্ড মাস্ক বা সুলতান কাবুজ গ্র্যান্ড মসজিদ।
১৯৯২ সালে সুলতান কাবুজ নিজ দেশে একটি আইকনিক মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন এবং সেই অনুযায়ী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মসজিদের নকশা আহ্বান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাড়া জাগানো স্থাপনা ও চোখ ধাঁধানো মসজিদের নকশা প্রণয়নকারী ইরাকি স্থপতি মহম্মদ ম্যাকিয়া এ প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হন। তারই নকশা অনুসরণ করে ক্যারিলিয়ন আলাওই এলএলসি নামক ওমানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছয় বছর সাত মাস সময়ে বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার প্রকৌশলী, কারিগর ও শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন সুলতান কাবুজ গ্র্যান্ড মসজিদ।
সার্বিকভাবে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের পাথর, কাঠ ও কাচ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখ টন বেলেপাথর আনা হয় ভারত থেকে। মসজিদের দরজা ও জানালার চারদিকেও স্থাপন করা হয়েছে হরেকরকম পাথর। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কাঠ, কাচ ও পাথরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অপরূপ শৈল্পিক নকশা। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের কথা স্মরণ করে মসজিদেও নির্মিত হয়েছে পাঁচটি মিনার, যার মধ্যে প্রধান মিনারের উচ্চতা প্রায় ৯০ মিটার (৩০০ ফুট) আর চার কোনায় নির্মিত চারটি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা সাড়ে ৪৫ মিটার (১৪৯ ফুট) করে। মসজিদের বাইরেও বড় জমায়েতের ইমামতি ও দর্শনার্থীদের তথ্য প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুসজ্জিত স্থাপনা রয়েছে।
মসজিদে প্রার্থনার জন্য নির্মিত মূল এবাদতখানাটি বর্গাকার, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৪৭ দশমিক ৪ মিটার (২৪৪ ফুট)। বর্গাকৃতি এমন হলঘরের ৫০ মিটার ১৬০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে কেন্দ্রীয় বাবুল গম্বুজ খচিত এমন উচ্চ গম্বুজ পৃথিবী স্থাপত্য নকশার এক বিস্ময়, যা দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক স্থপতি ও প্রকৌশলী। এ এবাদতখানায় ৬ হাজার ৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে সক্ষম। এ ছাড়া ৭৫০ জনের ধারণক্ষমতাবিশিষ্ট মহিলাদের একটি পৃথক এবাদতখানাও রয়েছে এই মসজিদে। মসজিদসংলগ্ন বহিরাঙ্গনে নামাজ আদায় করতে পারেন আট হাজার নামাজি। ৪ লাখ ১৬ হাজার বর্গমিটার (৪৪ লাখ ৮০ বর্গফুট) এলাকা নিয়ে এ মসজিদ কমপ্লেক্সটি অবস্থিত, যার মধ্যে মূল মসজিদ ভবন ইমারত নির্মিত হয়েছে ৪০ হাজার বর্গমিটার (৪ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুট) এলাকার ওপর। এ ভবন ও বাইরের খোলা চত্বরে প্রায় ২০ হাজার মুসলমান একত্রে এবাদত করতে সক্ষম।
মসজিদের ভেতরের কারুকাজ ও সৌন্দর্য দেখলে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যায়। ইরানে প্রস্তুতকৃত ৭০ মিটার (২৩০ ফুট) দৈর্ঘ্য ও ৬০ মিটার (২০০ ফুট) প্রস্থের এ কার্পেট ৪৩৪৩ বর্গমিটার (৪৬৭৫০ বর্গফুট) ফ্লোর এরিয়া মেঝে মুড়ে দিয়েছে। একসময় এককভাবে বিছানো এ কার্পেটটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্পেট। ২১ টন ওজনের এই কার্পেটে ব্যবহৃত পারস্য নকশা ও ২৮টি শেডের প্রাকৃতিক রং (ভেজিটেবল ডাই) সবার নজর কাড়ে। বর্তমানে এটি বিশ্বের বৃহত্তম কার্পেট। আর বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্পেট রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদে।
এ মসজিদের আরেক আকর্ষণ ইতালিতে নির্মিত ১৪ মিটার (৪৬ ফুট) লম্বা ঝাড়বাতি। মসজিদের ৯০ মিটার (৩০০ ফুট) উচ্চতার কথা মাথায় রেখে আনুপাতিক উচ্চতায় ওই ঝাড়বাতি নির্মাণ ও স্থাপন করা হয়। সাড়ে আট টন ওজনের এ ঝাড়বাতিটিতে রয়েছে ছয় লাখ ক্রিস্টাল (স্ফটিক) ও ১১২টি হেলোজেন বাল্ব। একই ডিজাইনে নির্মিত আরও ৩৪টি ঝাড়বাতি স্থাপিত হয়েছে মূল ঝাড়বাতি চারপাশে। এটিও বিশ্বের বৃহত্তম ঝাড়বাতির স্বীকৃতি পেয়েছিল। ৪৭.৭ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঝাড়বাতি রয়েছে কুয়েতের আসসিমা ক্যাপিটাল মলে।
নির্দিষ্ট সময় ও ইসলামী শিষ্টাচার অনুসরণ করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব পর্যটক এ মসজিদ ঘুরে দেখতে পারেন। মসজিদের চারদিকে সবুজ গাছপালাবিশিষ্ট বিশাল পার্কিং এলাকা ও নানা রঙের ফুলবিশিষ্ট বাগান বছরব্যাপী পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শুক্রবারে জুমার নামাজের পর প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও বড় আড্ডা জমে গ্র্যান্ড সুলতান মসজিদ চত্বরে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট