হজে অতিবাণিজ্য কাম্য নয়

মোস্তফা কামাল।
মোস্তফা কামাল।ছবি : সংগৃহীত

গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া হজযাত্রী নিবন্ধন শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। পরে সময় পাঁচ দিন বাড়িয়ে করা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কোটা পূর্ণ না হওয়ায় এরপর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এর সময় আরও সাত দিন বাড়িয়ে নেওয়া হয় ৭ মার্চ। আবার ৯ দিন বাড়িয়ে ১৬ মার্চ শেষ দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। দফায় দফায় নিবন্ধন পেছানোর মূল রহস্য এখানেই। ধারণা করা যায়, ১৬ মার্চের পর তারিখ আর পেছাবে না। কোটা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধন সার্ভার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এবার পবিত্র হজের সম্ভাব্য তারিখ ২৭ জুন। সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে এবার হজের সুযোগ পাবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। তাদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাবেন ১৫ হাজার। অবশিষ্ট ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজের সুযোগ পাবেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। খরচের হেরফেরও আছে সরকারি আর বেসরকারি প্যাকেজে। এবার সরকারিভাবে হজ পালনে খরচ হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। আর বেসরকারিভাবে এজেন্সির মাধ্যমে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। এর মধ্যে বিমানভাড়া ১ লাখ ৯৮ হাজার, বাড়িভাড়া ২ লাখ ৫ হাজার, মিনার তাঁবু ভাড়া ১ লাখ ৬০ হাজার, ভিসা ফি ৮ হাজার ৫১৭, খাবার খরচ ৩৫ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত কথা এমন থাকে না। খরচও বেড়ে যায়। আর ভোগান্তি তো বোনাস বা সিস্টেম লস।

হজ প্রথমত মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ফরজ ইবাদতের একটি। এ ইবাদতটি শ্রমসাধ্য। অর্থযোগও প্রচুর। এখানে রয়েছে শারীরিক-মানসিক-অর্থনৈতিক সংযোগ। হজ হয়ে গেছে একটি বিজনেস আইটেম। যেভাবে পারছেন টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এ সেবা থেকে। ব্যবসা হাতানোর প্রবণতায় অনেকে ঝুঁকেছেন এ ব্যবসায়। যাদের অনেকে আবার ম্যানপাওয়ার ব্যবসায় সম্পৃক্ত। হজ তাদের কাছে মাস কয়েকের একটি মৌসুমি ব্যবসা। তাদের অফিস থাকে। নতুন করে অফিস নিতে হয় না। আদম বেপারিদের মতো তাদেরও সংগঠন আছে। হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাব নামের সংগঠনটি তা দেখভাল করে। এ বছর বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়া ও পরিষেবা খরচ বৃদ্ধি, ডলার ও সৌদি মুদ্রা রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সার্বিকভাবে হজের খরচ বেড়েছে বলে দাবি হাব নেতাদের।

প্রতিবছর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করে হাব। সরকারি প্যাকেজ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে হজের প্যাকেজ সাজায় তারা। হাবের তথ্য বলছে, গত বছর কোরবানি ছাড়া বেসরকারি ‘সাধারণ’ হজ প্যাকেজের সর্বনিম্ন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। চলতি বছর সেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬১৮ টাকা। সরকারিভাবে গত বছর হজযাত্রার দুটি প্যাকেজ ছিল। এর একটিতে ব্যয় ছিল (কোরবানি ছাড়া) ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। অন্যটিতে ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৪৯ টাকা। এবার হজের জন্য সরকারিভাবে একটি প্যাকেজই রাখা হয়েছে এবং এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় সরকারিভাবে হজযাত্রার খরচ বেড়েছে ন্যূনতম ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৫ টাকা পর্যন্ত। এমন দাম হাঁকানোর পেছনে যুক্তি আছে তাদের।

গত বছরের হজ প্যাকেজের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার বিমানভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১০ সালে সরকারি হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া ছিল ৯৬ হাজার ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে দেড় দশকের কম সময়ে হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিমানভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য বাড়িভাড়া বাবদ ব্যয়। গত বছর হজ প্যাকেজে বাড়িভাড়া (ভ্যাটসহ) ছিল ৬ হাজার ৫০৪ রিয়াল বা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২০১ রিয়াল বা ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। গত বছর বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি রিয়ালের দাম ২৪ দশমিক ৩ টাকা হিসাব করা হয়েছিল। চলতি বছর তা হিসাব করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা। হজের সময় পাঁচ দিন ধরে মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় হজযাত্রীদের বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে—তাঁবুর ব্যবস্থা করা, তাঁবুতে ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ, কম্বল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ ইত্যাদি। মোয়াল্লেম সেবা হিসেবে পরিচিত এসব পরিষেবার জন্য খরচ গত বছর প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৫২০ রিয়াল বা ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে তা বেড়ে হয় ৫ হাজার ৬৫৬ রিয়াল বা ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ বছর এই খাতের খরচ মাত্র ২ রিয়াল বেড়েছে। তবে মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ায় তা ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা হয়েছে।

খরচ কমার খাতও আছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের হজ প্যাকেজে মোটাদাগে ব্যয় কমেছে দুই খাতে। সৌদি আরবে অবস্থানকালে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে পরিবহন ব্যয় বাবদ গত বছর নেওয়া হয়েছিল ৪২ হাজার ৬৩৫ টাকা করে। এবার তা কমে হয়েছে ৩৫ হাজার ১৬২ টাকা। এ ছাড়া প্রতিজন হাজির স্বাস্থ্যবীমা বাবদ সৌদি সরকারকে আগে দিতে হতো ২ হাজার ৬৭৩ টাকা। এ বছর তা কমে হয়েছে ৯৪৭ টাকা। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, হজের প্যাকেজ ঘোষণার পর কোনো কারণে খরচ বৃদ্ধি পেলে, তা হজযাত্রীকেই পরিশোধ করতে হবে। আর অব্যয়িত কোনো অর্থ থাকলে তা ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে। টাকার বিপরীতে রিয়ালের দাম আরও বাড়লে হজের খরচ আরও বাড়বে।

হজ একটি বড় রকমের ইবাদত বলে এর দিকে ব্যবসায়িক নজর থাকবে না—এমন নীতিকথার সুযোগ নেই। নীতি-নৈতিকতা, ভয়, ভক্তি ব্যবসায়ের কাছে খাটে না! অন্তত আমাদের দেশে এ বিষয়ে তাই মনে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হজ নিয়ে তো এত ব্যবসা হয় না—সে কথা বলার জায়গায়ও নেই। বরং ‘কেউ না গেলে নাই’—এমন সাফ কথার বাজার আছে। হজপ্রার্থীরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খরচের তফাত জানেন না এমনও নয়। নিজ গরজেই তারা তা সংগ্রহ করেন; কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। জনসংখ্যা বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার হজযাত্রীদের খরচ অনেক কম। জনপ্রতি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৩ টাকার বেশি নয়। হজযাত্রায় আরও টাকা লাগলে তা দেশটির সরকারের ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া থেকে হজে যেতে সর্বনিম্ন ২ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ ও সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিবছর হজে ভর্তুকি হিসেবে মালয়েশিয়া সরকার ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। প্রতিবেশী ভারতে হজে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হলেও খরচ আমাদের মতো নয়। এসব নিয়ে প্রতিবছরই কথা হয়। বচসা জমে। কারও পছন্দ না হলে বা সামর্থ্যে না কুলালে না যাবেন—এ সাফ কথায় বাদবাকি যুক্তি আর টেকে না। এগুলো যে একদম মনগড়া কথা এমনও নয়।

মক্কা-মদিনায় আবাসন, মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু, বিছানা, খাবার, যাতায়াতে খরচ কী হারে বাড়ে তা অনেকের ধারণার বাইরে। তা টানতে গিয়ে বেসরকারি হজ কারবারিদের পুঁজিতে টান পড়ে যায়। তার ওপর এ বছর টাকার বিপরীতে সৌদি রিয়ালের দাম বেড়েছে। গত বছর হজের সময় সৌদি রিয়ালের দাম ধরা হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা। সেই হিসাব ধরে তারা এবার খরচবৃদ্ধির মাত্রা আরও চড়িয়েছেন। ব্যবসা বলে কথা। এ ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর থেকে টানা বাড়ছে হজের খরচ। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬, ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার, ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার, ২০১৮ সালে ছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার, ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে সীমিত পরিসরে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এসব হিসাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হলেও খরচের তারতম্য বিস্তর। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩-এ হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অথচ এবার সৌদি সরকার হজে আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। মোয়াল্লেমের খরচ কমিয়েছে। হজের সময় সৌদি সরকার নানা ধরনের সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করে। মক্কা থেকে আরাফাহ, মিনা, মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে পরিবহনব্যবস্থা থাকে। সরকারের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি বিনামূল্যে পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। হজ ব্যবসায়ীরা এ তথ্যগুলো আলোচনায় আনেন না। এ ছাড়া হজের মতো ধর্মপালনের রীতিকেও সরকার লাভজনক ব্যবসার জায়গায় এনে ঠেকানোর কথা আনলে তারা সাইড কেটে চলে যায়। সামনে অন্য কথা নিয়ে আসে। যুক্তি হিসেবে লস গুনতে গুনতে তারা কাহিল হয়ে পড়ছে, তাদের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে—এমন তথ্যও আছে তাদের কাছে।

হজের সময়টা সৌদিতেও একটা বাণিজ্য মৌসুম। দেশটিতে সবকিছুর খরচই বেড়ে যায় তখন। পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান প্রতিবছর হজ করতে সৌদি যান। ওই সময়টাতেই সৌদি আরবের আর্থিক লেনদেনের হার অনেক বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে বিশেষ অর্থযোগ ঘটে। হজ ও ওমরায় বিভিন্ন দেশ থেকে কত মানুষ সৌদি যেতে পারে, তখন কত আয় হতে পারে—এ-সংক্রান্ত হিসাব তারা আগেই কষে রাখে। গত বছর হজ থেকে সৌদি আরবের সরাসরি আয় হয়েছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার।

লেখক : কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com