
এবারের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বড় রকমের গণ্ডগোল পাকবে, রাজপথের সংঘর্ষের রাজনীতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বারান্দায়ও পৌঁছে যাবে—অপেক্ষাটি ছিল আগ থেকেই। সেই অপেক্ষা বাস্তব হয়েছে। এ-সংক্রান্ত নেপথ্য আয়োজন চলেছে কয়েকদিন ধরেই। আয়োজকদের মধ্যে এখন আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বেশি সাফল্য ঘরে তুলতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট হয়েছে গত বুধ ও বৃহস্পতি দুদিন। প্রথম দিন বুধবার সেখানে ভোটের বদলে ছিল ঘাট বা টার্মিনাল শ্রমিকদের মতো সংঘাত পরিস্থিতি। এর জেরে চলেছে পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান, বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পুলিশের পাইকারি পিটুনি। এর মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় নতুন কলঙ্কের রেকর্ড নিশ্চিত হলো। পরদিন বৃহস্পতিবারও দুপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান ও ধাক্কাধাক্কি। এর মধ্য দিয়ে ‘একতরফা’ নির্বাচনের পুরো কলঙ্ক এখন সরকারের ঘাড়ে। এর চেয়ে বড় কথা, পুলিশি কাণ্ডসহ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে যা আর কখনো ঘটেনি। তাৎক্ষণিক এর বেনিফিশিয়ারি বিএনপি। তারা বলতে পারছে, এটিই এ সরকারের চরিত্র। মাস কয়েক পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমনই হবে। পুলিশ বিএনপি ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে ছাড়বে।
বিএনপির এমন অভিযোগ খণ্ডানো সরকারের জন্য কঠিন। আইনজীবী সমিতির সব পদ একতরফা আয়ত্তে নিয়ে তারা এ অভিযোগকে আমল পাইয়ে দিতে পারছে। নির্দলীয় পেশাজীবী সংগঠন বলা হলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্যানেলের একটি সরাসরি আওয়ামী আইনজীবী সমর্থিত। নাম ‘সাদা দল’। আরেকটি ‘নীল দল’ বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের। গতবার পর্যন্ত মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য ছিল। তবে গতবারেরটি নিয়েও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। এর পরও ওই নির্বাচনে বা বিদায়ী কমিটিতে সমিতির কার্যকরী সভাপতি, সম্পাদকসহ সাত সদস্য ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগপন্থি। কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদকসহ অপর সাত সদস্য বিএনপিপন্থি। এবার সবকটি নিয়ে গেছে ক্ষমতাসীনরা। এবার এমন একটা কিছু চলছিল, এতে সংশ্লিষ্ট সাধারণ ও পেশাদার আইনজীবীদের ধারণা ছিল, ঘটনা শুধু ঘটার বাকি। এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতেই কমিটির আওয়ামী লীগপন্থি সদস্যরা একতরফাভাবে নির্বাচন উপকমিটি গঠন করেন। এরপর বিএনপিপন্থি সদস্যরাও আরেকটি উপকমিটি ঘোষণা করেন।
তাদের এমন পাল্টাপাল্টি উপকমিটি গঠনের পর নির্বাচন নিয়ে সংশয় শুরু হয়। এতে তাদের ধারণাটি বাস্তবতা পেতে থাকে। শেষে তাই হলো। ভোটের এক দিন আগে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করেন, যা শঙ্কাকে আরও সম্ভাব্য করে তোলে। মনসুরুল হক চৌধুরীর পদত্যাগের পর দুইপক্ষ আবার পাল্টাপাল্টি নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়কের নাম ঘোষণা করে এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণকে উত্তপ্ত করতে উঠেপড়ে লাগে। প্রকারান্তরে নোংরা পরিস্থিতিকে আরও নিশ্চিত করে তোলে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, হৈচৈ ও হট্টগোলে। সন্ধ্যার দিকে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং হাতাহাতির ঘটনা। এতে বেশ কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। আর সাংবাদিকদের পিটিয়ে নতুন ঘটনার জন্ম দেয়। পুলিশ যেভাবে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের মারধর করেছে, তা ন্যক্কারজনক। সামরিক শাসনের সময়েও পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এ রকম কাজ করার সাহস পায়নি। পেশাদার আইনজীবীরা হতভম্ব নির্বাচনের এ ঘটনায়। সমিতি ভবনে পুলিশের তৎপরতায় বেশিরভাগ আইনজীবী অসন্তুষ্ট, লজ্জিত।
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে এমন একটি পরিস্থিতি হোক, তা কারা চেয়েছে? এ সবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে কে? পুলিশকে ডেকে এনে লেলিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে কে? এ প্রশ্ন যৌক্তিক হলেও ঘটনা অনেকের ধারণার বাইরে। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে কি এভাবে পুলিশ আসতে পারে? অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, ‘আগের রাতে মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অন্যরা ব্যালট পেপার নিয়ে ছিঁড়ে ফেলায় বাজে কিছু ঘটার শঙ্কায় সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক পুলিশের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। প্রশ্ন এখানেও। আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের কি সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে পুলিশ ডাকার এখতিয়ার আছে? আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগে পুলিশ কি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছে?
প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট জবাব কারও কাছে নেই। প্রশ্ন আরও আছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচনের নিয়ম নেই। তবু কেন তা হয়ে আসছে? কোন নিয়মে দীর্ঘদিন ধরে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন হয়ে আসছে সুপ্রিম কোর্টে? জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এর কারিগর বড় দুদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা। এই দুই প্যানেলে কারা থাকবেন, তা ঠিক করে দেন দুই দলের শীর্ষ কয়েক নেতা। এর সুবাদে আইনজীবী সমিতিগুলো পেশাজীবী চরিত্র হারিয়ে শুধু ট্রেড ইউনিয়ন নয়, বড় দুই দলের আজ্ঞাবহ অঙ্গে রূপ নিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি যেনতেন পেশাজীবী সংগঠন নয়, গুরুত্ব বিবেচনায় অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের চেয়ে এর গুরুত্ব আলাদা। কিন্তু গুরুত্ব হারিয়ে এটিও এখন স্রেফ দলবাজির সংগঠনে পর্যবসিত হয়েছে। মাস কয়েক পরই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এই ‘একতরফা’ নির্বাচন বাজে বার্তা দিচ্ছে। দায় পুরোটা বর্তেছে সরাসরি সরকারের ওপর। বিএনপি এ ইস্যুতে বেশ ফুরফুরে। জিতলেও এত খুশি তারা হতো কিনা সন্দেহ, যা খুশি জোগান দিয়েছে পরাজয়ে। বিএনপি নতুন করে বলছে, সারা দেশে সব পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনও এমন হবে—এ কথা বলছে চড়া গলায়। অন্যভাবে বলা যায়, সরকারই তা বলার সুযোগ করে দিয়েছে বিএনপিকে।
জাতীয় রাজনীতির পথপরিক্রমায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে চলমান পেশির দাপট বিচারাঙ্গনে, আইনজীবীদের সংগঠনেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে যা ঘটে গেল তার মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য কঠিন বার্তা দিতে পেরেছে বিএনপি। তা জাতীয় নির্বাচনের একটি ড্রেস রিহার্সাল কি না, সচেতনদের মাঝে এ নিয়ে জোর আলোচনা, তীব্র উদ্বেগ। আগের বার ছিল এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ। এবার যোগ হলো সহিংসতা। পুলিশ দায়িত্বরত সাংবাদিকদেরও পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়ার মধ্যেও বার্তা।
আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের সাদা দল ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নীল দলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনী কাণ্ডকীর্তি সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয় নির্বাচনী বার্তার মতো। নিজস্বতার অপমৃত্যু ঘটিয়ে পেশাজীবীরা নিজস্ব নির্বাচনকে যেভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নির্বাচনে এনে ঠেকিয়েছেন, তা সাংবাদিকদের সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠনকেও মামুলি করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠনেও এখন এমনই হয়। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাসহ অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজকদের সংগঠনগুলোতেও হয়। তা চলে রিকশা, ঠেলা বা ঘাট শ্রমিকদের সংগঠনগুলোতেও। গত সপ্তাহে আগামী সংসদ নির্বাচনে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত না হওয়ার বিষয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বাস্তবে তার এ অঙ্গীকার রক্ষার চিত্র সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের সময় যা হয়েছে তেমন কিছু হবে কি না দুশ্চিন্তা ভর করেছে। পরিচয়পত্র, মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও তাদের হামলা থেকে একটুও রেহাই দেয়নি পুলিশ। বরং আরেকটু বেশি করেছে। পিটুনির সঙ্গে বোনাস হিসেবে অশ্রাব্য গালাগাল। হামলায় আহত সাংবাদিকদের আটকেও রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের পিটুনি খাওয়া বিএনপিকে বাড়তি কথার জায়গা করে দিয়েছে।
নির্বাচনের মাঠে সামনে পুলিশ কী করবে বা করতে পারে—এ ব্যাপারে নানা কথা কচলানির মওকাও পেল বিএনপি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য ৯ হাজারের মতো। গড়পড়তা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ৬ হাজার। এক দিনে ৩ হাজারের জন্য পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হলো ৫০০ জন। অর্থাৎ প্রতি ছয়জন ভোটারের জন্য একজন পুলিশ মোতায়েন। এ স্টাইলে জাতীয় নির্বাচন করতে হলে সারা দেশে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভোট কাস্ট করতে কত পুলিশ দরকার, তারা আছে? তার চেয়ে বড় কথা, মানুষ যে অঙ্গনে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় ঘোরে, যে অঙ্গনটিকে ভরসা হিসেবে সমীহ করে–সেখানেই এ দৃশ্য বড় বেদনার। পেশাজীবী সংগঠনগুলো পেশাদারিত্ব হারিয়েছে কবেই। পেশার চেয়ে দলীয় রাজনীতিই তাদের কাছে মুখ্য। অথচ পেশাজীবী সংগঠনের আলাদা একটি মর্যাদা রয়েছে। প্রয়োজনও রয়েছে। আমাদের দেশে সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্মিলিত পেশাজীবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং পেশাজীবীদের রাজনীতি নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে তখন সাধারণ মানুষের কাছে সে আন্দোলন সহজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ নানা পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের আমরা সাধারণত পেশাজীবী হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। তাদের বিরুদ্ধে দলবাজি-সুবিধাবাদী ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে পেশাগত নানা সমস্যা তাদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয়। সে কারণে পেশাজীবীদের নানা স্তরে গড়ে উঠেছে পেশাভিত্তিক নানা সংগঠন। পুলিশসহ এ শ্রেণিটির হাতে জাতীয় নির্বাচনের সময়ও অনেক দায়িত্ব। একটি পেশাজীবী সংগঠনের ক্ষেত্রে তাদের যে পারফরম্যান্স, জাতীয় নির্বাচনে তা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে—এ প্রশ্নটি অবান্তর নয়।
লেখক: কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন