
আজ ২৫ মে, ১১ জ্যৈষ্ঠ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের এই দিনে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় আনার পর তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এ মর্যাদার পেছনে রয়েছে নজরুলের লেখায় বাঙালি জাতি গঠনের মৌলিক তাগিদ এবং শান্তি-সম্প্রীতির জন্য ঐক্য ও সাম্যের প্রতি কবির আজীবনের সাধনা।
আজ থেকে ঠিক ৫১ বছর আগে কবি নজরুল স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। বঙ্গবন্ধুর বহু মৌলিক কাজের মধ্যে অন্যতম হলো কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত। তখন কবির ছিল ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু ১৯৪২ সাল থেকে তিনি জাগতিক চেতনালুপ্ত ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তার সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া যথার্থ। নজরুল যেমন দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখে ফুঁসে উঠেছিলেন; বঙ্গবন্ধু তেমনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। এই একই উদ্দেশ্যে যেহেতু দুজনের জীবন ধাবিত ছিল; এটি প্রায় একটি ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা হয়ে পড়ে—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করলেন, সেটারই জাতীয় কবি হবেন নজরুল। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়, তেমনি নজরুলকে কবিতার রাজনীতিক বলা যায়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় যান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সফরে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নেওয়ার এক অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভারতে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কলকাতার রাজভবনে, যা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন। তৎকালীন রাজ্যপাল এ এল ডায়াসকে তিনি প্রথমে এ কথাটা জানান।
পশ্চিমবঙ্গের নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক বাঁধন সেনগুপ্ত ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—‘শেখ মুজিব রাজ্যপালকে বললেন, দেখুন, আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই শহরেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। কবি নিজেও আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। এবার আমরা চাই কবিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধুমধাম করে তার জন্মদিন পালন করতে।’
এ এল ডায়াস সব শুনেটুনে বললেন, ‘অতি উত্তম প্রস্তাব। এমন তো হতেই পারে। আমরা না হয় পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম; একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়! তবে দিল্লিই পারবে এ অনুমতি দিতে। ফলে আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গেই কথা বলুন।’ পরদিনই শেখ মুজিব ঠিক সেটাই করলেন।
এরপর বঙ্গবন্ধুর নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ আর কূটনৈতিক তৎপরতার পর অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে একটি বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে কলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় এসে পৌঁছেন বাংলার জনমানসের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কথা বলতে পারতেন না। চিন্তাশক্তিও অচল। অথচ তার বিদ্রোহ ও সাম্যের চেতনাই যেন আপ্লুত করেছিল বাংলাদেশের জনমানুষকে।
ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় ‘কবি ভবন’। সেখানে কবিকে রাখা হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। কবি ভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকত। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে দেওয়া হয় ‘একুশে পদক’।