চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১২:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষুধা ও অপুষ্টি

মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষুধা ও অপুষ্টি

দেশের সরকার খুব ভালো করেই জানে, বাংলাদেশে শিশুদের অপুষ্টির হার খুবই বেশি,সরকারি সহায়তা ছাড়া, শুধু পরিবারগুলোর পক্ষে সুষম আহার জুগিয়ে শিশুপুষ্টির লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়, তা-ও সরকার জানে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, চালের দাম বাড়লে গরিব মানুষ মাছ-মাংস, ডাল, ফলমূলের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়। শাকসবজি খাওয়া বাড়িয়ে দেয় তারা। আবার গরিব মানুষ যত খরচ করে, তার এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় চাল কিনতে। তাই চালের দাম কমবেশি হলে তার প্রভাব গরিব মানুষের ওপর বেশি পড়ে।

গরিব মানুষের খাবারের তালিকায় এমনিতেই মাছ-মাংস, ডিম, ফলমূলের অংশ কম। যখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, তখন এসব পণ্যের ভোগের অংশ আরও কমে যায়। মূল্যবৃদ্ধির ফলে কোপ পড়েছে শিশুদের খাবারে। ডিম হারিয়ে যেতে বসেছে পাত থেকে। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, এ দেশে অপুষ্টির মূল কারণ একেবারে খেতে না পাওয়া নয়, সুষম খাবার না পাওয়া। শিশুদের প্রয়োজন প্রোটিনযুক্ত এবং বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেলের মতো ‘মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট’যুক্ত খাবার। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু অন্তত ছয় মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটে করে ডিম খায়, তাদের অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কিন্তু ডিমের দাম বর্তমানে গরিবের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ অবনতি হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) এ বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ থেকে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। গত বছর ১১৭টি দেশের মধ্যে ওই জরিপ করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম।

অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয়—যে কোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ওই সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত, প্রতি ছয়জনের একজন শিশু বয়সের তুলনায় খর্বকায় ও কৃশকায়। এ ছাড়া প্রতি তিনজনের একজন শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। এই সবকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় তা কম। যে কারণে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে।

ক্ষুধাবিষয়ক প্রতিবেদন বলছে, দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য কমেছে, কিন্তু পরিপার্শ্বের তুলনায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির দাপট কমেনি, বরং বেড়েছে। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা কি তবে দুই পৃথক ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব? গবেষকদের অভিজ্ঞতা বলে, আয় সামান্য বাড়লে মানুষ পুষ্টির থেকে প্রসাধনের দিকে গুরুত্ব দেয়।

বর্তমানে একটি ডিমের দাম মোটামুটিভাবে তিনটি মিনি প্যাক শ্যাম্পুর সমান থাকে। একটি গবেষণায় কিশোর-কিশোরীরা জানায়, রোজ একটা ডিম খেলাম কিনা সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু শ্যাম্পু করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রকাশ্যে সেটা বোঝা যায়। বন্ধুসমাজে এর একটা প্রভাব আছে। কিন্তু এর ফলে খিদে মিথ্যে হয়ে যায় না। অপুষ্টি মিথ্যে হয়ে যায় না।

আয় সামান্য বাড়লে ভোক্তার আগ্রহ পুষ্টির থেকে মনোহারি বা বিলাসবহুল পণ্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াই নয়, পর্যাপ্ত বৃদ্ধির জন্য আবশ্যক যে পুষ্টি, তার প্রতি বহুস্তরীয় উদাসীনতাও একটা বড় কারণ। পরিবারের ভেতরে লিঙ্গবৈষম্য,‌ জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন এককে এর বিস্তার ধরতে পারা যায়। একটি সচ্ছল পরিবারের একটি সন্তান পরিপুষ্ট এবং অন্যটি অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণের ফলে রুগ্‌ণ—এ চিত্রও কিছু আশ্চর্যের নয়। মফস্বল শহরের সম্ভ্রান্ত কোনো একটি গার্লস কলেজে বিত্তশালী পরিবার থেকে পড়তে আসা ছাত্রীদের মধ্যে গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, খাদ্য গ্রহণে অনীহা এবং তা থেকে হিমোগ্লোবিন কম হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় তাদের একটা বড় অংশ আক্রান্ত। অথচ, তাদের মধ্যেই কোনো কোনো পরিবারে তাদের ভাই (বিশেষত ভাই হলে, বয়সে ছোট তদুপরি পুত্রসন্তান) যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। বোঝা যায় যে, কন্যার খাদ্য গ্রহণে অনীহার বিষয়টি নিয়ে পরিবারের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। জীবনযাত্রার ধরন ও খাদ্যাভ্যাস এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রার ধরন বলতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা গ্রামীণ কৃষিশ্রমিক অথবা মফস্বলের গৃহপরিচারিকার আয়ের ওপর চলা কোনো পরিবারে মোবাইল ফোনে অফুরান কথা বলার সুবিধা পাওয়া অথবা কেব্‌ল টিভির বিনোদনের জন্য মাসিক খরচের বরাদ্দ যেভাবে গুরুত্ব পায়, পুষ্টির কথা সেভাবে উঠে আসে না। আর খাদ্যাভ্যাস? দ্রুত খিদে মেটানোর জন্য কম দামের প্যাকেটজাত খাবার গরম জলে ফুটিয়ে মসলা ঢেলে খাওয়াই হোক, অথবা হোটেল থেকে খাবার অর্ডার করে খাওয়ার সময়; বহু ক্ষেত্রেই শুধু স্বাদ গুরুত্ব পায়, পুষ্টি নয়। তবে কি অপুষ্টি শুধু কথার কথা? খিদে কি শুধুই তথ্য?

আসলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যবিষয়ক যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়, সেখানে পরিসংখ্যান থাকে। তার ভেতরে অসংখ্য তথ্য, তাকে ঘিরে অজস্র তর্ক। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, তথ্য কিন্তু আজ আর শুধু তথ্য নয়। এখন বলা হচ্ছে, ‘ডেটা ইজ ডিসকোর্স’। আগে মনে করা হতো যে, কোনো ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তথ্যের প্রয়োজন হয়। এখন তথ্য নিজেই ভাষ্য। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন এবং একগুচ্ছ বিষয়ের হিউম্যানিটিজ থেকে সোশ্যাল সায়েন্সের দিকে যাত্রাসহ আরও বিভিন্ন কারণে তথ্য আজ আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপী। একই সঙ্গে তথ্য অতি ক্ষমতাবান।

মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ইউএনডিপি, অক্সফাম ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে ক্ষুধা, অসাম্য, দারিদ্র্য বা আয়-বৈষম্যের মতো বিষয় নিয়ে রিপোর্ট আসে। তার প্রচ্ছদে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে বুভুক্ষু চোখ। কীভাবে এ তথ্য সংগ্রহ হয়? কারা করেন? কেন করেন? তাদের অভিসন্ধি কী? এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা তো আছেই, তার সঙ্গেই আছে খুব সহজে নিজের সুবিধামতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সেই তথ্যকে ব্যবহার করা। সেই তথ্য নিয়ে চলে কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ। সেমিনার হয়। লেখা হয় গবেষণাপত্র। গ্রহণ এবং বর্জনের খেলা চলে।

কিন্তু সেসব তথ্য, পরিসংখ্যান, তর্ক, গ্রহণ ও বর্জন পার করে দারিদ্র্য কমেছে মনে করে আত্মতুষ্টি অনুভব করার আগে ফ্লাইওভারের নিচে, রেলস্টেশনের পাশে অথবা গ্রামে বাস করা প্রান্তিক মানুষদের ঘরে কর্মহীনতা, আয় হ্রাস পাওয়া, মূল্যবৃদ্ধি—এরকম নানা আঘাতে নানা দিক থেকে একটু একটু করে তুবড়ে যাওয়া হাঁড়িটার কথা ভাবা দরকার। হাঁড়িটা কীভাবে চাল আর জলসমেত প্রতিদিন আগুনে বসতে পারে, তার কথা ভাবা দরকার।

আমাদের দেশের সরকার খুব ভালো করেই জানে, বাংলাদেশে শিশুদের অপুষ্টির হার খুবই বেশি, সরকারি তথ্যই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দেয়। সরকারি সহায়তা ছাড়া, শুধু পরিবারগুলোর পক্ষে সুষম আহার জুগিয়ে শিশুপুষ্টির লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়, তা-ও সরকার জানে। কিন্তু শিশুপুষ্টির দায় সরকার গ্রহণ করলেও, তা পালন করার সদিচ্ছা দেখতে পারেনি এখনো।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই যে, কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে একটি অগ্রহণযোগ্য বড়সংখ্যক শিশু অব্যাহতভাবে কয়েক ধরনের অপুষ্টির বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এটা একটা ব্যাপক মানব ক্ষতি। কেননা অপুষ্টি এবং এর ফলে শিশুর দুর্বল মানসিক বিকাশের ভবিষ্যতে এ শিশুদের জীবনভর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়। এ ছাড়া মানবজীবনের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় এটা একটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিতেও ভূমিকা রাখে।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো নিয়ে আরও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা প্রয়োজন। কোনো ধরনের সন্দেহ না রেখে একটি স্বাস্থ্যকর ও ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ে তুলতে অবশ্যই সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে এবং সেই প্রচেষ্টা এখনই দরকার। জরুরি প্রয়োজনবোধকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না।

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪৬তম বিসিএস প্রিলি শুক্রবার, যেসব নির্দেশনা মানতে হবে

দ. আফ্রিকায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে হত্যা

যমুনা গ্রুপে ডিরেক্টর পদে চাকরি, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের ইসতিসকার নামাজ

ছন্দ হারানো মোস্তাফিজকে ‘চাচার’ পরামর্শ!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে আসছে নতুন সিদ্ধান্ত

শরীয়তপুরে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ

২৩৮ জনের বড় নিয়োগ দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়

মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে ৬ ধাপ পেছাল বাংলাদেশ

দেশের জন্য আইপিএল ছাড়ছেন রাজা

১০

রাফাকে ‘মৃত্যুপুরী’ বানাতে চায় ইসরায়েলি সেনারা, নির্দেশের অপেক্ষা

১১

জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন সংখ্যা বেড়েছে

১২

হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

১৩

বিশ্বকাপের আগে টাইগার কোচের ‘বিশেষ’ পরিকল্পনা

১৪

কেন রাতে ধান কাটছেন কৃষকরা

১৫

উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হবে : সিইসি

১৬

এক জেলায় পাঁচ সাগর

১৭

ম্যানসিটি-আর্সেনালের দিকে তাকিয়ে ক্লপ

১৮

ভোলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৯

উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির দুই নেতাকে শোকজ

২০
*/ ?>
X