হাসান হাফিজুর রহমান খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমালোচক। তিনি ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জামালপুর শহরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে বিএ এবং ১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাগত জীবন খুবই বৈচিত্র্যময়। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সওগাত, ইত্তেহাদ, পাকিস্তান এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত দুবার তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর নিযুক্ত হন এবং সোভিয়েত লেখক সঙ্ঘের আমন্ত্রণে আলমা আতায় অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সরকারের সংস্থাপন শাখায় যোগদান করেন এবং ১৯৭৮ সালে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প’-এর পরিচালক নিযুক্ত হন।
তার সাহিত্যচর্চার শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং এ বছরই তার বিখ্যাত কবিতা ‘অমর একুশে’ রচিত হয়। ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম সংকলন গ্রন্থ একুশে ফেব্রুয়ারি। এ বছর তিনি ড্রামা সার্কেলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মননশীল প্রবন্ধ ‘কবিতার বিষয়বস্তু’ ও ‘আধুনিক কবিতার লক্ষণ’ রচনা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তিনি সাহিত্যপত্র সমকাল (১৯৫৭) সম্পাদনায় সিকান্দার আবু জাফরের সহযোগী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তানি শাসকচক্র কর্তৃক বাংলা বর্ণমালা ও বানান সংস্কার এবং পাকিস্তানের আদর্শ পরিপন্থি বলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
হাসান হাফিজুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার আজীবন অনুরাগ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় সাংবাদিকতা করলেও গণচেতনা ও গণদাবির প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার সাহিত্যকর্মে জনজীবনের প্রত্যাশা, যন্ত্রণা, প্রতিবাদ এবং মানুষের সংগ্রামী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। সমাজ ও জীবনের অঙ্গীকারে তার সাহিত্য হয়ে উঠেছে বাস্তবমুখী। বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় আধুনিক কাব্যান্দোলনের যে উন্মেষ ঘটে, তার অন্যতম স্থপতি ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হাসান হাফিজুর রহমান পাকিস্তান লেখক সঙ্ঘ পুরস্কার ও আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সুফী মোতাহার হোসেন স্মৃতি পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক এবং একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল হাসপাতালে মারা যান।