ইয়োসি মেকেলবার্গ
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে

ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে

কিছুদিন আগেও ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এমনকি কেউ কথাটা বিশ্বাসও করত কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। তবে এ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক সহিংসতা। আর এসব ঘটনার শুরুটা অনেক আগে থেকেই।

সময়টা ১৯৯৫। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এক শান্তি আলোচনার মাঝেই একজন ইহুদি আততায়ী প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রাবিনকে হত্যা করেন। এ ঘটনার পরও ইসরায়েলি সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো সংঘাত বা সংঘর্ষ দেখা দেয়নি। তবে এ গুপ্তহত্যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে এক ধরনের রাগমিশ্রিত ক্ষোভ দেখা দেয়।

আশার কথা এই যে, সময়ের সঙ্গে সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন আলোচনায় গৃহযুদ্ধ শব্দটি প্রায়ই উঠে আসছে। যদিও ইসরায়েল রাজনৈতিকভাবে বছরের পর বছর ধরে কিছু হিংসাত্মক কৌশল অনুসরণ করছে। ইসরায়েলি গণতন্ত্রকে বাঁচানোর নামে অবাধে চলছে অস্ত্রের ব্যবহার এবং সম্ভাব্য রক্তপাত বা ফলাফল নিয়ে প্রগতিশীল কিছু শক্তি এরই মধ্যে কথাবার্তাও বলতে শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, এ ধরনের শব্দ শুধু রূপকভাবে ব্যবহার করা হয়। প্রকৃত সহিংসতার বিপরীতে ‘বলার জন্য বলা হয়েছে’ এ ধরনের শব্দ আসলে কোনো কাজে আসে না।

ইসরায়েলের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক। তবে এ শাসনব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে একটি নড়বড়ে ভিত্তির ওপর। আর মূল কারণ হচ্ছে, এ শাসনব্যবস্থায় মূলত কোনো লিখিত, উদার-গণতন্ত্রভিত্তিক সংবিধান নেই। এ কারণেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইসরায়েলের রয়েছে নানাবিধ দ্বন্দ্ব এবং দেখা দিচ্ছে নানারকম সামাজিক সংহতির ঘাটতি।

স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছরে, ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও (বৃহৎ আরব ফিলিস্তিনি সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে), দেশটিকে একাট্টা রাখার জন্য পর্যাপ্ত সংহতি থাকবে বলে যে ধারণা ছিল, তা এখন স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইসরায়েল বর্তমানে একটি সাংবিধানিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এ অবস্থা দেশটি স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে আগে কখনো দেখা যায়নি। এ সংকটের মূল কারণ হচ্ছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি গঠনে ব্যর্থতা। আর এ ব্যর্থতা দেশটিকে নিয়ে যাচ্ছে বিভাজনের দিকে। দেশটির জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা এ বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের জন্য বলতে গেলে একরকম উন্মত্ত হয়ে গেছেন। এ সুযোগটিই সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছেন ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু।

দুটি কারণে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলিরা সামাজিকভাবে একত্রিত ছিল। কারণ দুটো হচ্ছে—আশা ও ভয়। ইসরায়েলিদের আশা ছিল ২০০০ সালের পর এটি একটি ইসরায়েল একটি স্বাধীন ইহুদি দেশ হয়ে যাবে, যা হবে নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক। আর ভয়ের ব্যাপারটি ছিল তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া, যেখানে ইহুদি জনগোষ্ঠী আবার বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও নিপীড়নের মধ্যে বসবাস করবে। এ ছাড়া আরেকটি শঙ্কার ব্যাপার ছিল—কয়েক দশক ধরে তাদের নিকটতম ও অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা।

তবে বর্তমান সময়ে ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি না দিয়ে একে দুর্বল করতে যে শক্তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে কাজ করছিল এবং এর বিপরীতে যে প্রগতিশীল শক্তি বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ করছে, তাদের মধ্যে এখন সীমাবদ্ধতার রেখাটি আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। তবে তর্কের খাতিরে বলা যায় যে, একটি ইহুদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শুরু করার অর্থ কী তা নিয়ে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। কিন্তু এখানে আরও একটি কারণ আছে। এ ইহুদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

অনেক বছর ধরেই ইসরায়েলি সমাজের কিছু অমীমাংসিত ও অন্তর্নিহিত স্ববিরোধী ব্যাপার কখনো সামনে উঠে আসেনি। এসব ব্যাপার সযত্নে গোপন করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ফলে গোপন এ ব্যাপারগুলো এখন এক ধরনের মহিরুহে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষমতা সংগ্রহের জন্য তৈরি করছে এক উর্বর ক্ষেত্র। আবার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠরা এসব স্ববিরোধী ব্যাপার অঙ্কুরে বিনষ্ট করার পরিবর্তে যুক্তি দেখিয়েছিল, তারাই এখন ডানপন্থি সহিংসতার প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। তবে যারা এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটায়, তাদের শাস্তি দেওয়ার চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে তাদের আগে দমন করা। এ ধরনের লোকদের আসলে সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত।

ইসরায়েলে এ ধরনের আশঙ্কাজনক ঘটনা দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি ব্যর্থতাও বটে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই বোঝাতে অক্ষম হয়েছে যে, শান্তিপূর্ণভাবে একটি সুস্থ মতবিরোধ এবং সৃষ্টিশীল বিতর্কের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সমাজ গঠন করা যায়। আবার এটাও সতর্ক করা উচিত যে, সহিংসতা অবলম্বন করলে তা সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কারণ শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

লিকুদ প্রধানমন্ত্রীদের একটি মিছিলে গ্রিন লাইনের উভয় দিকে সহিংসতার জন্য নানারকম উসকানি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীদের সমর্থকরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একটি বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করেছে। আর এর সরাসরি ফলাফল হিসেবে আরব এবং শান্তিকর্মীদের লক্ষ্য করে নৃশংস কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। ইহুদি সন্ত্রাসীদের দ্বারা রাবিনের হত্যাকাণ্ড ঠিক সেরকমই একটি নমুনা। এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিক্ষিপ্ত এবং বর্তমানে ক্রমবর্ধমান। তবে এ সহিংসতা অধিকৃত পশ্চিম তীরে তাদের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে পরিচালনা করে আসছে।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভাজন চালিয়ে ভয়ংকরভাবে দুর্বল সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান এক অন্ধকার শিল্পে পরিণত করেছিলেন। তবে তিনি সবসময়ই সহিংসতাকারীদের একধাপ পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তার বর্তমান সরকারের আমলে তিনি ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে কিছু দুর্বৃত্তদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মনে হচ্ছে যেন তিনি অপরাধ ব্যাকরণ সঠিকভাবে অনুসরণ করে নিজেকে রাজনৈতিক মিত্র এবং উপদেষ্টাদের মাঝে ঘিরে রেখেছেন। আর এর ফলে তাকে নিয়ে বিতর্কের সূচক নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। যারা তার মতামতকে অপছন্দ করে বা মেনে নিতে চায় না, তাদের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন সহিংসতা। আবার অন্যদিকে এসব ঘটনার ফলে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রগতিশীল এবং রক্ষণশীলদের মধ্যে নানা ধরনের উত্তেজনা, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতা, ইহুদি, আরব এবং অন্যান্য জাতির মধ্যে ভয়, ঈর্ষা এবং ঘৃণার মতো মৌলিক আবেগগুলোকে জাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তবে যারা ধারণা করছেন যে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অস্তিত্বের হুমকির মুখে, তারা দৃঢ়ভাবে ধারণা করছেন এ যুদ্ধ যদি সংঘটিত হয়, তাদের সমাজ হেরে যাবে না। তারা এমন সব পরিভাষা ও বক্তব্য ব্যবহার করছেন যেন সশস্ত্র প্রতিরোধ বা গৃহযুদ্ধ পরিহার করা যায়।

ইসরায়েলে গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ এখনো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সহিংসতা মূলত ডানপন্থি দুর্বৃত্তদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এসব আক্রমণ বা সহিংসতা ঘটানোর মূল কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি দ্বন্দ্বকে প্রজ্বলিত করা। তবে ইসরায়েলের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব নানা সময়ে কিছু সামরিক পরিভাষা ব্যবহার করছেন। এর ফলে মনে হচ্ছে যে যদি কোনো সংঘাত দেখা দেয়, তাহলে সে সংঘাতে ব্যাপকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার সম্ভাবনা বহুলাংশে বেড়ে যাবে।

এ দেশে যারা সুপ্রিম কোর্টকে দেশের শত্রু হিসেবে গণ্য করেন এবং যারা একে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামগ্রিক প্রতিরক্ষার শেষ ঘাঁটি হিসেবে দেখেন, তাদের মধ্যে বিভাজনটি এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। এ বিভাজনের ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পরিস্থিতি নেই বললেই চলে। ইসরায়েল একটি বিপুলভাবে সেনা সমর্থিত বা সামরিকায়িত দেশ। এখানে বেশিরভাগ জনসংখ্যারই সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই বর্তমান বিতর্কের বিষাক্ততার কারণে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাকে আর ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

ইসরায়েল এখন স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে। তাই এ সময়ে দেশটিকে অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে ইহুদি এবং গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় তা আবার সংজ্ঞায়িত করার জন্য হয়তো একটি সংকটের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তবে এ সংকটটি অবশ্যই সভ্য পদ্ধতিতে এবং গণতান্ত্রিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঘটতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— ট্রেন কি স্টেশনে আছে না ছেড়ে গেছে?

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের একজন প্রফেসর। প্রবন্ধটি আরব নিউজ থেকে অনুবাদ করেছেন তৌহিদা জান্নাত

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট

সাতকানিয়ায় প্রতীমা ভাংচুরে যুক্তদের বিচারের দাবি পূজা উদযাপন পরিষদের

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে বেধড়ক পেটালেন আ.লীগ নেতা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, পরীক্ষার রুটিনে পরিবর্তন আনল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকায় কাতারের আমিরের নামে সড়ক ও পার্ক

ইরানে হামলার খবর এক দিন আগেই যেভাবে পেল যুক্তরাষ্ট্র

গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক ২০২৪ / বিশ্বকে বাঁচাতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধের দাবি তরুণদের

বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভেঙে ঢুকে গেল বাস, নিহত প্রকৌশলী

স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

জুভেন্তাসের বিরুদ্ধে বড় জয় রোনালদোর

১০

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি নির্বাচন / ভোট শেষে গণ্ডগোলের আশঙ্কা

১১

ছাত্রলীগ নেতার পর এবার আ.লীগ নেতার ভিডিও ভাইরাল

১২

কেন ৪৪ দিন ধরে চলবে ভারতের নির্বাচন

১৩

সরকারের প্রত্যেকটি অন্যায়ের রেকর্ড আছে : রিজভী

১৪

স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: প্রতিমন্ত্রী

১৫

শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে

১৬

ইসরায়েলি হামলার পর ইরান এখন কী করবে

১৭

ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য করার প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো

১৮

১৩ বছর পর বাংলাদেশে আসছে জাল ব্যান্ড

১৯

নতুন ওয়েব ফিল্মে মেহজাবীন

২০
*/ ?>
X