আবেদ খান
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফিরে আসুন আবার এই বিপন্ন সময়ে

ফিরে আসুন আবার এই বিপন্ন সময়ে

একটি ধর্মান্ধ, কুসংস্কারময়, নানান সংকটের অন্ধকারে নিপতিত সমাজ থেকে নারীদের আলোতে নিয়ে আসতে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হলেন—বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। অভাবনীয় প্রতিকূলতাকে পায়ে মাড়িয়ে সমাজ, নারী কিংবা বলা যায় তথা মানুষের জন্য অদম্য সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে। কাজেই, বাঙালি নারী জাতির কথা বলতে গেলে তার নাম তো অবধারিতভাবেই সামনে চলে আসবে। কালে কালে তিনিই ছিলেন নারী মুক্তির আদর্শ, অনুপ্রেরণা ও মুক্তির দিশারি।

তিনি সবসময়ই সমাজে সাম্যের কথা বলেছেন; পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক সমাজ গড়ার কথা ভাবেননি। তার স্বপ্ন ছিল, সমাজে নারী ও পুরুষ যাতে একসঙ্গে সমান মর্যাদায় অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। নারী মুক্তির সঙ্গে তার কাছে প্রধান ছিল সমগ্র সমাজব্যবস্থার উন্নতি। তিনি নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।’

আমরা যদি আজ থেকে ১০০ বছর আগের সমাজের দিকে দেখি তাহলে দেখতে পাব—নারীদের জন্য ভয়ংকর ও অচিন্ত্যনীয় নিষ্ঠুর একটি সমাজচিত্র! আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা রক্ষণশীল সমাজ; যেখানে একটি মুসলিম পরিবারে নারীর জীবন মানেই পর্দার আড়ালে বন্দি জীবন! ধর্মের অপব্যাখ্যায় তাদের শিক্ষালয়ে যাওয়ার কোনো অধিকার, নিজের জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই নিজে নেওয়ার স্বাধীনতা নেই; খাঁচায় বন্দি পাখির মতো পরাধীনতার শিকলবেড়িই তাকে আমৃত্যু বহন করতে হতো। একটা সমাজে রোকেয়া সাখাওয়াত একজন প্রমিথিউজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আলোর মশাল নিয়ে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করার সংগ্রামে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। কারণ, তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন— ‘কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশ-মাতৃকার মুক্তি অসম্ভব।’

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বেগম রোকেয়াও ছিলেন এমনই একটি কঠোর পারিবারিক ও কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনের বলয়ে আবদ্ধ নারী। যার নিজেরও পড়ালেখা করার অধিকার ছিল না, পরিবারের স্বীকৃতিও ছিল না। তার পিতা ছিলেন নারী শিক্ষার ঘোরবিরোধী। তিনি তার দুই পুত্রকে কলকাতায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। কিন্তু কোনো মেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দেননি। শুধু বাড়িতে কোরআন শিক্ষার সুযোগ রেখেছিলেন। নারীকে দাসী জ্ঞান করা পুরুষশাসিত সেই সমাজই তার ভেতরে পরাধীনতার শিকল ভাঙার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্ম দিয়েছিল। জ্ঞানার্জনের অদম্য অনুরাগ ও মুক্তির বাসনাকে তার পিতা কিংবা সমাজ কেউই রোধ করতে পারেনি। ভারতবর্ষের অন্ধকারবাসিনী ভগিনীদের যিনি মুক্তির স্বাদ দিতে চেয়েছেন; যিনি নারীকে সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে মানুষ হওয়ার পথ দেখিয়েছেন; তাকে কি কোনোক্রমে আটকানো সম্ভব! কাজেই, গভীর রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখাপড়া করেছেন। পরিবারের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, তখন ভাইয়ের কাছে লিখতে-পড়তে শিখেছেন। পিতার অজান্তেই তিনি ভাইয়ের কাছে বাংলা, ইংরেজি শিখেছেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায় স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে, নারীশিক্ষা বিস্তারে তার দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও গড়ে তোলেন নারীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল।

সেদিনের সমাজের যে চিত্র এবং আজকের যে মুক্ত ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কতখানি নির্ণয় করা যায় এটাও এখন ভাবার সময় এসেছে। বহুকাল ধরে সমাজ পুরুষতন্ত্রের একটি কট্টর ব্যবস্থাপনার মধ্যেই পুরোপুরি আটকে গিয়েছিল। সেই সমাজে যে শুধু সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আর বেগম রোকেয়ার নিজের প্রতিবন্ধকতা ছিল তা নয়; নারী জাতির নিজের নিষ্ক্রিয়তা ও তাদের বিভিন্ন ধরনের জড়তাও তার তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ও বেদনার কারণ হয়েছিল। তিনি খুব দুঃখ করেই নারী জাতির সমালোচনা করেছেন এবং জেগে ওঠার জন্য কড়া ভাষায় বলেছেন— “বহুকাল হইতে নারী-হৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায়, নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই দাসী হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্বতা বলিয়া কিছু নাই—এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত লক্ষিত হয় না। তাই বলিতে চাই, অতএব জাগো, জাগো গো ভগিনি। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।”—এ বাণী তিনি চিরকাল নিজের অন্তরে ধারণ করেছিলেন।

তাহলে এই প্রশ্ন তো অনিবার্যভাবেই আসে যে আজ ১০০ বছর পেরিয়ে বাঙালি সমাজ প্রকৃতপক্ষে কতখানি এগোতে পেরেছে? বাঙালি নারী জীবনের যে পরিবর্তন শতবছর আগে বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন। নানারকম প্রতিকূলতা, নানারকমের নির্যাতন-হেনস্তা-সহিংসতার শিকার নারী আজও যে অন্ধকারবাসিনী বা অবরোধবাসিনী নয়, সে কথা কি আমরা বলতে পারি সেভাবে? আবার এ কথাও অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে স্বীকার করতেই হবে যে, আজ থেকে ১০০ বছর আগে যে সমাজে অবস্থান করে বেগম রোকেয়া সমাজের প্রতিষ্ঠিত অবস্থানকে তার প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, তার সংগ্রামের কথা বলেছেন, লিখেছেন, সমাজ পরিবর্তনের কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদিত করেছেন, আজকের সমাজে বেঁচে থাকলে তিনি কি তা করতে পারতেন? তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্ম অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে দাবিয়ে রাখার এক অস্ত্র। তাই তিনি ধর্মের নামে নারীদের অবদমিত করে রাখার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন—‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ...আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ… ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’ আজকে আমাদের এ কথাগুলোকে ভাবতে হবে যে বর্তমান সময়ে যদি তিনি কথাগুলো বলতেন তাহলেই কি তিনি টিকতে পারতেন?

আমরা যদি একটু লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব আমাদের সমাজে একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ভালোমন্দ নিয়ে বিশ্বায়নের একটি মুক্ত ঢেউ এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তার মধ্যে অন্যতম। আমরা দেখতে পাই একটা ভয়ংকর শক্তি আমাদের চোখের সামনেই নতুন করে মাথা গজাচ্ছে—তা হলো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদী অপশক্তির আস্ফালন, সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অপতৎপরতা। ধর্মের নামে এই একটি শ্রেণি সমাজকে স্তব্ধ করে রাখার ষড়যন্ত্র আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আর দেখা যায়, তাদের প্রধান টার্গেটও কিন্তু এই নারীই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজ যদি বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকতেন তাহলে এই মৌলবাদী অশুভ শক্তি কি তার কর্মযজ্ঞ চালাতে দিত? নারীমুক্তির কথা, পুরুষ দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার কথা, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর বন্দিদশার পেছনে এ কুচক্রীদের চক্রান্তের কথা, বলতে দিত? আমরা দেখেছি কত নিষ্ঠুরভাবে ‘নাস্তিক’ হত্যার নামে এ অপশক্তির হাতে রক্তের হোলি খেলা চলেছে! আমরা দেখেছি, পুরো সমাজটাকে বিশেষ করে নারীকে তারা কতভাবে ঘরের মধ্যে বন্দি রাখার পাঁয়তারা করতে পারে। ঘরে ও ঘরের বাইরে নারীর অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও কি আমরা বলতে পারছি যে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেছে?

বাংলাদেশের জন্মের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন। নারী উন্নয়ন নীতিমালাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইনও প্রণয়ন করা হয়েছিল। তখন নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ কাজের পরিবেশও তৈরি করার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিল। কাজেই আমরা বেগম রোকেয়াকে যদি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে সম্মান করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই তার কর্মকে সম্মান দেওয়া, তার চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং তার প্রদত্ত সামগ্রিক মানসিক বিকাশের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া ছাড়া আমাদের কি কিছু করণীয় আছে?

“দেহের দু’টি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সবরকমের কাজকর্মের প্রয়োজনে দু’টি চক্ষুর গুরুত্ব সমান”—বেগম রোকেয়ার এ কথাটাকে হৃদয়াঙ্গম করতে হবে, অনুভব করতে হবে আসলে নারীকে শুধু নারী নয়, তাকে মানুষ হিসেবে দেখা এবং তার পরিপূর্ণ সম্মানকে সর্বত্র নিশ্চিত করা আর শুধু তার ভেতর দিয়েই বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন সার্থক হতে পারে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর পাবিপ্রবিতে পানির ফিল্টার স্থাপন

সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে লিটন : কোচ

জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ

ডামি নির্বাচনের সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে : রিজভী

কাশ্মীরে যাত্রীবাহী গাড়ি গভীর খাদে, নিহত ১০

যুক্তরাষ্ট্রের জার্সিতে খেলবেন সাবেক কিউই তারকা

রাজার আমন্ত্রণে ভুটানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী

নেতাকে ফাঁসাতে গিয়ে আ.লীগ কর্মী গ্রেপ্তার

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / স্বাধীনতা দিবসের নামে চাঁদা দাবি করায় ইউএনওর ২ স্টাফ বদলি

১০

স্কুটারে বসেই অফিস করছেন তিনি, ভিডিও ভাইরাল

১১

মোস্তাফিজদের ম্যাচ দেখায় নতুন রেকর্ড

১২

এখনো যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে ফিলিস্তিনিরা

১৩

‘বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে জিয়াউর রহমানও লজ্জা পেয়ে যেতেন’

১৪

কুমিল্লায় গত ১১ মাসে শতাধিক মামলায় গ্রেপ্তার ৪৬৭

১৫

বৃষ্টি হলেই সড়ক হয়ে যায় পুকুর, জনদুর্ভোগ চরমে

১৬

ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তালিকা / পেলে-ম্যারাডোনা নয় সর্বকালের সেরা মেসি

১৭

আইপিইউ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরলেন স্পিকার

১৮

৫ হাজার মূল্যের বাতি ২৭০০০ টাকায় কিনেছে রেল!

১৯

মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট-ডিসের তার অপসারণের নির্দেশ

২০
*/ ?>
X