সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে একের ভেতর দুই (টুইন ওয়ান) নয়, কয়েকটি মোটা দাগের ঘটনা। একদিকে নানা গুঞ্জন, সন্দেহ, কটু কথার অবসান। আরেকদিকে রাজনীতির বাঁকবদলের স্পষ্টতা। নতুন কমিশন ঘটনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সড়ক নকশাসহ নমুনা স্পষ্ট। বাকি থাকছে দিন-তারিখ, মানে শিডিউল ঘোষণা। ২১ নভেম্বর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দিনটি বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী দিবস। আনুষ্ঠানিকতাসহ এদিনটির গুরুত্ব উচ্চমাত্রার। সেখানে এবার আরেকমাত্রা যোগ হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যোগদানে। শুধু যোগদানই নয়, মূল ফোকাসই হয়ে যান তিনি।
এক যুগেরও বেশি সময় পর সেনাকুঞ্জের এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে আসার সুযোগ হলো। হাসিনা সরকারের ইচ্ছার রায়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে জোরপূর্বক মাইনাস টু থিওরি প্রথম প্রয়োগ হয়েছিল তার ওপর। তার এ উপস্থিতি রাজনীতির জন্য একটি বার্তা। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে খালেদা জিয়াকে সম্বোধনসহ কয়েকটি কথায় তা আরেকটু পরিষ্কার।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতাদের বিনীত শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাঝেও উপলব্ধির কিছু আছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান তিন নেতা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাক্ষাতের ছবিসংবলিত ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়। এই ফটোকার্ডে ছবির ওপর লেখা হয়, ‘সোনালী অতীত, গর্বিত ভবিষ্যৎ।’ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সেই সাক্ষাতের ছবি শেয়ার করে সারজিস আলম লেখেন, ‘আপনার আপসহীন মনোভাব আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’
একই দিনে উপরোক্ত এসব বার্তার সমান্তরালে নতুন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীনের অঙ্গীকার হচ্ছে—মানুষ যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটার সর্বোচ্চ চেষ্টা করার। এ ব্যাপারে যাবতীয় চ্যালেঞ্জ নেবেন তিনি। বলেই ফেলেছেন, ‘২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এ আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়।’ এক সময়ের তথ্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সচিবের পেশাগত ক্যারিয়ার বড় বর্ণাঢ্য। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে এখনই আগাম কিছু বলতে চান না তিনি। সময় হলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। সেই অপেক্ষার আগেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানান, হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার পর আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে। মার্কিন সাময়িকী টাইমকে এ কথা বলেছেন তিনি। সিইসি নিয়োগ এবং সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানের ২১ নভেম্বরই প্রকাশ হয় টাইমের প্রতিবেদনটি। সেখানে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘(নির্বাচনে) অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য যে কারও মতো তারা স্বাধীন। আমরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মোকাবিলা করব।’
টাইমের প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন; ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন; সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন; মানবাধিকার; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হবে নাকি সংসদীয় ব্যবস্থা থাকবে, সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট থাকবে নাকি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, সেগুলো এখনো নির্ধারণ হয়নি। সংবিধান সংস্কারের বৈধতার জন্য গণভোটের প্রয়োজন রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তবে এ সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান কোনো রাজনীতিককে যুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে তাড়াহুড়াও করতে চান না প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ভাষ্যমতে, নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো নির্ধারণ করেনি সরকার। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমাদের রেললাইন ঠিক করতে হবে, যাতে ট্রেন সঠিক দিকে যেতে পারে।’
এর মধ্যে কিন্তু নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার তিনি। নির্বাচন বিষয়ে খুব প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি সাখাওয়াত হোসেন। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে নির্বাচন হতে পারে আভাস তার। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসে গত মঙ্গলবার মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েস ফর বাংলাদেশ’ আয়োজিত সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। সম্মেলনে ৫ আগস্টের আগে ও পরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন আলোচকরা। এতে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী পল স্কালি বলেন, ‘বাংলাদেশে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তার সঠিক তদন্ত শেষে যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।’ লর্ড হোসাইন তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সব সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে সব ধরনের সহায়তা পাবে।’
দিন-তারিখ ঠিক না হলেও নির্বাচনের হাট জমে গেছে, আলামতও বোধগম্য—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনের রোড আর ম্যাপ দুটোই মোটামুটি স্পষ্ট। কথামালাও জমজমাট। চারদিকে পরামর্শের ঝড়। পুরোনো কথাও আসছে নতুন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের পদমর্যাদা মন্ত্রীদের ওপর নির্ধারণ করা, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, ‘না’ ভোটের বিধান আবার চালু করা, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারের সমর্থনযুক্ত সইয়ের বিধান বাদ দেওয়া, জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংজ্ঞায় ‘নির্বাচন’-এর সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট করাসহ কত যে পরামর্শ।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ব্যস্ত। কমিশন এখন পর্যন্ত ২১-২২টি বৈঠক করেছে। নির্বাচনসংক্রান্ত সব আইন ও বিধি পর্যালোচনা করা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে মানুষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে লিখিত প্রস্তাব দিচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাবও আছে। ২২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে প্রস্তাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে কমিশন। গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করার কথা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘যাত্রা শুরু করা নির্বাচনী ট্রেনকে সামনে এগোতে এগোতে অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে, এই ট্রেনের শেষ স্টেশনে পৌঁছানো নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি রেললাইনগুলো বসিয়ে দেওয়ার ওপর, যা করা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’ তাতে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ধারণার চেয়ে কম সময়ে তাদের কাজ শেষ করে বিদায় নিতে চাইছে। আবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারে তার সরকারের মেয়াদ নিয়ে ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যাও বাদ নেই। এর মাঝে নির্বাচন কমিশন গঠন ও সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠান প্রেক্ষাপট আরও বদলে দিতে শুরু করেছে। নতুন আলোচনা-জিজ্ঞাসা যোগও হচ্ছে। বাকিটা নির্ভর করছে নতুন কমিশন ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ওপর।
নির্বাচন আর প্রশাসন যে খুব প্রাসঙ্গিক এ বিষয়টি প্রশ্নের মতো করে আলোচনায় এসেছে নতুন সিইসির দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। তার কাছে প্রশ্ন ছিল—বিগত নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কী করবেন? জবাবে বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা হচ্ছে তরল পদার্থের মতো। পাত্র অনুযায়ী রং ধরে, পাত্র যে রকম, তারাও ওই রং ধরে। যখন তারা দেখবে সঠিক নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে। তারাও তো মানুষ, তাদেরও তো ভাই-ব্রাদার এই দেশে আছে। তারাও তো চায় যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন এই দেশে হোক। তাদের হয়তো অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন তারা দেখবে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় সরকার, তারা সহযোগিতা করবে।’
নির্বাচনের জন্য কতদিন সময় লাগতে পারে, জানতে চাইলে নতুন সিইসি বলেন, নির্বাচনের জন্য তো কিছু প্রস্তুতি আছেই। অনেক ছেলেমেয়ের বয়স ১৮ হয়ে গেছে। তাদের ভোটার তালিকায় আনতে হবে। আবার শুধু জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোটারের তালিকা করলে হবে না। উপজেলা নির্বাচন হবে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে, এর জন্য আলাদা তালিকা করতে হবে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই। নির্বাচন কমিশন গঠন ও প্রধান বক্তব্যের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রবেশের বার্তা গেল জনগণের কাছে। চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রত্যয়ের কথাও এলো। মনে রাখতেই হবে, এবারের সময় ও প্রেক্ষিতটা ভিন্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। এর এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এখন নতুন এই নির্বাচন কমিশন। তারা যেন ১৪, ১৮, ২৪ না হয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন