কঠিনেরে জয় করে আরও কঠিনের পথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আগামী নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষা—এ বার্তা দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে রেখেছেন আরও আগেই। যারা যদ্দূর পেরেছেন বুঝেছেন। এর সমান্তরালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে তার নিজের জন্যও রাজনীতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। দলের ভেতর-বাইরেসহ গোটা রাজনীতিতে যে উচ্চতায় এখন তার অবস্থান, সেটির ফলোআপ এবং আপডেট আরেক দায়। সঙ্গে কঠিন দায়িত্বও। লেখা বা উচ্চারণের অনুপযুক্ত শব্দ ছাড়া যারা তার নাম নিতেন না, তাদের মুখে এখন ভিন্ন সুর। নাম উচ্চারণের আগে-পরে ‘জনাব’, ‘সাহেব’ সম্বোধন।
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয়, পলাতক মন্ত্রী হাছান মাহমুদরা কী-সব ভাষায় তারেক রহমানের নাম মুখে নিতেন, তা মাস কয়েক আগের ঘটনা মাত্র। এখন ‘জনাব’ তারেক রহমান ‘সাহেব’-এর সঙ্গে মিলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পয়গামনামা তাদের। বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয় ও হাছান মাহমুদের এ ‘জনাব-সাহেব’ উচ্চারণ ‘সুধী দর্শক-শ্রোতামণ্ডলীকে আচমকা ধাক্কা খাইয়ে দিয়েছে। ঘোড়ারও হাসার দশা। আর বাংলার ছাত্রদের জন্য উপভোগের। ‘জনাব’ বললে ‘সাহেব’ বলতে হয় না, ‘সাহেব’ বললে ‘জনাব’ বলতে হয় না—তাদের এ শিক্ষার মাঝে কী যে ছেদ পড়ল; জনাবের সঙ্গে সাহেব যোগ করে সম্মান-ভক্তি পোক্ত করার এই নমুনা।
আবার এটাই বাস্তবতা। তারেক নিজেকে ক্রমেই একটা উচ্চমাত্রায় নিয়ে আসতে সক্ষম হওয়াতেই পরিস্থিতির এ হেরফের। বাচনে বচনে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার উচ্চতার ছাপ সম্প্রতি আরও বেশি দৃশ্যমান। দেশের এ কঠিন সময়ে তার পরিপক্বতা কারও কারও কাছে ম্যাজিকাল। তার ‘ভোটের অধিকার নিশ্চিত হলে কোনো দল নিষিদ্ধ করার দায়ভার রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে না’—সাম্প্রতিক বক্তব্যটি ঝানু রাজনীতিকদেরও রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে। দলীয় একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল বক্তব্যে তারেক রহমান এও বলেছেন, বরং জনগণ নিজের ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে খুনি, লুটেরা, টাকা পাচারকারী কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে থাকা মাফিয়া চক্রকে প্রত্যাখ্যান করবে।
ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গেলে নিশিরাতে ভোট বা ডামি, স্বামী, আমি প্রার্থীর পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে—এ কথা মিনমিন করে নয়, চড়া গলায় বলেছেন অনুষ্ঠানটিতে। তার এসব বক্তব্যের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির কিছু খোরাকও বিদ্যমান। জনগণের আদালত এবং রাষ্ট্রীয় আদালত; দুটিকে কার্যকর করা গেলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির উল্লেখযোগ্য গুণগত সংস্কার নিশ্চিত হবে—এমন মন্তব্যও করেছেন তিনি। তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার হতে হবে রাষ্ট্রীয় আদালতে। কোনো ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ রাজনীতির মাঠে; অর্থাৎ জনগণের আদালতে হওয়ার সংস্কৃতি চালু করা গেলে একটি রাজনৈতিক সংস্কার হয়ে যাবে।
আর দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আত্মবিশ্বাসী হয়ে জনবচ্ছিন্ন না হতে। মানুষ অপছন্দ করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আওয়ামী লীগের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তাদের। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়ার আভাসও ছিল তার সেদিনের বক্তব্যে। প্রায় পৌনে দুই যুগ ধরে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ, বহু শোক, সংকট মোকাবিলা যে তারেক রহমানকে ইস্পাতকঠিন করে তুলেছে, দলের অনেকের চেয়েও বেশি মালুম করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রকাশ চাপা রাখতে পারেননি তিনি। প্রসঙ্গ ছাড়াও তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ, তাকে তুই-তোকারিসহ নিম্নমানের ভাষায় আক্রমণ করা ছিল প্রকারান্তরে তারেকের প্রতি শেখ হাসিনার হিংসা ও অসহিষ্ণুতার নোংরা প্রকাশ। লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল, শেখ হাসিনার এসব ভাষার কোনো জবাব দেননি তারেক রহমান। একদিকে এর পরিণাম বা প্রতিফল দেখতে সময় লাগেনি। অন্যদিকে প্রাপ্তি মিলেছে দ্রুত।
বিগত সরকারের অবিরাম অপপ্রচার, প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীর নিয়মিত গালমন্দ, ভেংচি, খিঁচুনির জবাবে না গিয়ে তারেক রহমান এগিয়েছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তার কাজ তিনি করেই গেছেন, যা ক্রমেই তাকে ঝালাই দিয়েছে। স্বতন্ত্র উচ্চতায় নিয়ে ভিন্ন পরিচিতিও দিয়েছে। এর সুবাদে সুদূর থেকে দূরদর্শিতা পোক্ত করেছে। খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তোলার শক্তিও দিয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে তা একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। পাশাপাশি দেশের রাজনীতি ও বিপ্লবে করে তুলেছে আরও প্রাসঙ্গিক। তুমুল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কীভাবে অটল-অবিচল থেকে ক্রমেই উচ্চতায় ওঠা যায়, সে ক্ষেত্রে পাঠপঠনের মতো উদাহরণ হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান। অন্য এই তারেক তাই অনেকের কাছে হয়ে উঠেছেন নতুন করে চেনার ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে তার দলের তৃণমূলের কাছে হয়ে উঠেছেন ছায়াসঙ্গীর মতো।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। দেশে ফিরতে মানা, কথা বলতে মানা, কথা প্রচারেও আদালতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিনি এগিয়েছেন হাত-পা বাঁধা সাঁতারু হয়ে। তার দৃঢ়তার সামনে নির্যাতকদেরই পরাস্ত হতে হয়েছে নিদারুণভাবে। তারেক রহমানের নাছোড়বান্দা ভূমিকায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রই তৈরি করেনি; বিপ্লব-পরবর্তী স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটও তৈরি করেছেন ধারণাতীতভাবে। যেখানে একজন নির্যাতিত হিসেবে যার নিজেরই প্রতিহিংসাপরায়ণতায় আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার শঙ্কা করেছেন অনেকে, সেখানে তিনি ছিটিয়েছেন শান্তির ছটা। সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্ত থাকার। ফ্যাসিস্টদের প্রতি মারমুখী না হতে, যা বাংলাদেশের বর্তমানেই ইতিহাস রচনা করেছে। সরকারবিহীন কয়েকটা দিনেও একটি দেশকে স্থিতিশীলতা রক্ষার এ ব্যবস্থাপককে ইতিহাস তার পাল্লাতেই পরিমাপ করবে।
দায়িত্বশীলতার মাপকাঠিতে অন্তর্বর্তী সরকারের চলার পথকে সুগম করতেও তার নানামুখী পদক্ষেপ রাজনীতির অভিধানে এরই মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারের নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন তারেক রহমান। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি আহতদের সুচিকিৎসার আপডেট নিচ্ছেন নিয়মিত। এর আগে, প্রতিটি বন্যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, করোনা মহামারির সময়ও তার এ ধরনের পদক্ষেপ ছিল, যা অনেকের জানা এবং ধারণার বাইরে। বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তার সহায়তা এখনো বেখবরে, যা জানেন শুধু সংশ্লিষ্ট কয়েকজন। সময় এবং পরিস্থিতির অনিবার্যতায় ইতিহাসের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের বর্তমানও আবর্তিত হচ্ছে তারেক রহমানকে ঘিরে।
ওয়ান ইলেভেন জমানায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় তারেক রহমানকে। গ্রেপ্তারের পর অমানুষিক নির্যাতন। আর রচনা করা বদনাম-কলঙ্ক ছিল বোনাস। ১৮ মাস কারান্তরীণ থাকার পর জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশ ছাড়েন যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে। সেই থেকে এখনো লন্ডনে নির্বাসনে। সেখান থেকেই দল পরিচালনা। একেক সময় দলটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার রাষ্ট্রীয় মহাআয়োজন। সফর তো হয়ইনি, বরং এসব নোংরামিতে দল হয়েছে আরও টেকসই-সংগঠিত। আর এ দীর্ঘ সময়ে তিনি যা হারিয়েছেন, তা ফেরত পাওয়ার নয়। সহোদর ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জীবনাবসান হয়েছে, মা খালেদা জিয়া কয়েক দফায় পৌঁছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
অন্যদিকে, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানও এই পুরোটা সময় নির্যাতন হজমের শিকার ও দৃষ্টান্ত। কেবল তারেক রহমানের স্ত্রী হওয়ার অপরাধে ডা. জুবাইদা রহমানকে হেন অপদস্ত নেই, যা না করেছে শেখ হাসিনার সরকার। ডা. জুবাইদা বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। তার পরীক্ষার ফল চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ঈর্ষণীয় বিষয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে এমবিবিএস পাস করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারের সদস্য। তার পিতা রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান বাংলাদেশের নৌবাহিনীর প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী। মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানু একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। তার শ্বশুর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। তার শাশুড়ি খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। জুবাইদাকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্তই নয়, সম্মানহানির এক রত্তিও বাকি রাখা হয়নি।
এমন কঠিন সময়েও টলেননি, ভাঙেননি তারেক রহমান। কারও কারও বিশ্লেষণে প্যারিসের নির্বাসন জীবন খোমেনিকে বিশ্বের কাছে তার বক্তব্যকে আরও সহজে পৌঁছে দিয়েছে। লন্ডনের নির্বাসন তারেক রহমানকেও করেছে অপ্রতিরোধ্য, দেশের মিডিয়া তার বক্তব্য প্রচার করতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্সিং, সোশ্যাল মিডিয়া ও আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে দেশের আনাচে-কানাচে তৃণমূল থেকে জাতীয় পরিসরে আরও দীপ্তমান করেছে। দলের অস্তিত্বকেও করেছে আরও যূথবদ্ধ। গেল বছর ১৩ জুলাই সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দল থেকে দেওয়া হয়েছে ৩১ দফা। এর আগে, ভিশন ২০৩০ রূপকল্প। যেখানে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন অবিরত। সেইসঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের রেখেছেন অনেকটা তারের ওপর। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপির প্রায় অর্ধসহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে জারি রয়েছে তার কঠোর বার্তা। এসবের যোগফল ও রসায়ন তার প্রশংসা-সমাদর-গ্রহণযোগ্যতায় বাড়তি বাতাবরণ যোগ হয়েছে। আগামী দিনের রাজনীতিতে তার দায় ও দায়িত্বের কাঠিন্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন