রোড এবং ম্যাপ মিলিয়ে নির্বাচনের অভিযাত্রা এখন দৃশ্যমান। নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে। বৃহস্পতিবার জারি হয়েছে প্রজ্ঞাপনও। আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম, পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগমকে নিয়ে গঠিত কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার খুঁজবে। এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পাঁচ সংস্কার কমিশনের গেজেটও হবে দুয়েক দিনের মধ্যে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম স্পোকসম্যান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আশ্বস্ত করেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশের মানুষকে উপহার দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। জানান, সেই কাজের ধারাবাহিকতায় ইসির সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। তবে এ নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল অংশ নেবে আর নেবে না তা অন্তর্বর্তী সরকারের নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য উপদেষ্টার। এই আশ্বাস দিতে তিনি এও স্পষ্ট বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ তিনটি—জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার, বিভিন্ন খাতে সংস্কার এবং সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা।
রিজওয়ানার এই তিন কাজের তত্ত্বের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব একটাই। সেটা হচ্ছে, গত ১৫ বছরের জঞ্জাল সরিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া। আ স ম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভায় তিনি এ মত দেন। সেখানে বিভিন্ন দলের নেতারা টেকসই সংস্কারের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তাগিদ দেন। বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্রের শঙ্কা ও এর কিছু নমুনা দেখছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
নির্বাচনের এমন যাত্রাপথে এ ধরনের বক্তব্য ও শঙ্কা দেখার মধ্যে রাজনীতির কিছু বার্তা রয়েছে। আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে, ভোটের মাঠে কারা থাকবে—সেই বার্তাও আছে। সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি শোডাউনও হয়েছে। জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। সেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বিক্ষোভ করেছে। তারা জাতীয় পার্টি ঘোষিত ২ নভেম্বরের সমাবেশ প্রতিহতের ঘোষণাই দেয়নি, দিনটিতে সারা দেশে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে প্রতিরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণাও দিয়েছে। একপর্যায়ে রাত পৌনে ৯টায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গত তিনটি একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে কাজ করায় জাতীয় পার্টিকে বিচারের মুখোমুখি করে নিষিদ্ধের দাবি করে আসছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এর আগে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ব্যানারে মশাল মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে সামনে এলে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
বোঝার একটুও বাকি থাকছে না একদিকে নির্বাচনী অভিযাত্রা, আরেকদিকে এর অংশীজন কারা হবেন—সেই বার্তা আছে, যা ছিল এর আগে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এক সাক্ষাৎকারেও। এতে তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুত কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ‘ফ্যাসিবাদের সব বৈশিষ্ট্য’ প্রকাশ করছে। দেশের রাজনীতিতে এই দলের এখন ‘কোনো জায়গা’ নেই। এ অসিলায় মুখ খুলেছে আওয়ামী লীগ। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূসকে ‘অনির্বাচিত’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘এটি প্রতিশোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।’ একই দিন মুখ খুলেছে হাসানুল হক ইনুর জাসদও। দলের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা ডেকে তাদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর মুক্তি চাওয়া হয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সাফসতুরা করে এই সভাটি হয়। শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন আরেক জাসদও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সভা করেছে। তবে, তাদের অবস্থান ভিন্ন। ফ্যাসিবাদের বিচার চেয়েছে এই জাসদ। বলেছে, ফ্যাসিবাদের বিচার করে এ দেশের সাধারণ জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। বর্তমান সরকারকে গতানুগতিক নির্বাচন না দিয়ে জবাবদিহিমূলক নির্বাচন করার পরামর্শও দেওয়া হয় এই জাসদ থেকে। একদিনের এসব বক্তব্য ও ঘটনার পরতে পরতে নির্বাচনের যাবতীয় রসদ। রোডও বিদ্যমান। বাকি থাকছে ম্যাপ। এ ম্যাপিংয়ে যে কোনো দলের চেয়ে এগিয়ে বিএনপি। তা দলেও, দলের কয়েক সহযোগীর মধ্যেও। সংখ্যায় হাফ ডজন। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর ছয় নেতাকে এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে বিএনপির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সমঝোতার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ২২ অক্টোবর সমমনা শরিক জোটের ছয় নেতাকে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগে সহযোগিতা করার জন্য ছয়টি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনা-সংবলিত চিঠি দেয় বিএনপি।
এই ছয় নেতা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন উল্লেখ করে চিঠিতে তাদের নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগসহ সাংগঠনিক কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এ নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকার থানা, উপজেলা বা পৌরসভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অবহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে বলা হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা চিঠিদৃষ্টে সেই ছয়জন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা। আ স ম রব লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর), মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-৪ (শিবগঞ্জ), জোনায়েদ সাকি (ঢাকা-১২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), নুরুল হক পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা), রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২ (সদর ও হরিণাকুণ্ডু), এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫ (নিকলী-বাজিতপুর) আসনের। ওইসব জায়গায় নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে আগ্রহী বিএনপি নেতারা একটা মেসেজ পেয়ে গেছেন। তারা শুধু রোড নয়, ম্যাপও দেখছেন। প্রকাশ্যে কিছু বলা বা প্রতিক্রয়া জানানোর অবস্থা তাদের নেই। তবে, ভেতরে ভেতরে কথা চালাচালি হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে সব জেলায় আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বিগত আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে যেসব সমমনা রাজনৈতিক দল সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে, সেসব দলের শীর্ষ নেতারা নিজ আসনে যাতে নির্বিঘ্নে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য সার্বিক সহযোগিতা দিতে বলা হয়।
এ চিঠির সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলা হলেও সম্পর্ক আরও বেশি করে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দুটি জোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে। একটি ছিল জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট, আরেকটি ২০-দলীয় জোট। দুই জোটের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের শরিক দল ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন গণফোরামকে সাতটি, নাগরিক ঐক্যকে পাঁচটি, আ স ম রবের জেএসডিকে পাঁচটি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে দুটি আসন দেওয়া হয়। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে ধানের শীষ প্রতীকে ২৫টি আসন ছাড় দেওয়া হয়। এবার মোটেই ১৪-১৮ নয়। পরিস্থিতি চৌদ্দ-আঠারোর ধারেকাছেও নয়। একেবারে ভিন্ন আবহ।
আওয়ামী লীগসহ সাত-আটটি দলের ভবিষ্যৎ পুরোপুরিই কুয়াশাচ্ছন্ন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী সড়কের ধারেকাছেও নয় তারা। জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), ইনুর জাসদ, প্রয়াত বি চৌধুরীর বিকল্পধারা, তরীকত ফেডারেশনের মতো দলগুলোর জন্য ওই পথ বড় পিচ্ছিল। জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে হামলা এর একটি বার্তা। ক্ষমতাচ্যুতরা সহজেই হাল ছেড়ে দেবেন মনে করা যায় না। তাদের সহযোগীরা নানান কথা বলে মাঠে টিকে থাকতে চাইবে। ক্ষমতাচ্যুতদের অনুগত একটি গোষ্ঠী আছে, যা আরও ঝড়-ঝঞ্ঝার আশঙ্কা জাগাচ্ছে। একে গণঅভ্যুত্থানের গতি পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা প্রত্যাহার দাবি, আওয়ামী লীগসহ ১১টি দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধে রিট, পরে রিট না চালানোর ঘোষণার মধ্যে বাড়তি কথাও চাউর হচ্ছে। এ সময়টায় ঢাকা ঘুরে গেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। নির্বাচন, মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে জায়গামতো কথা বলে গেছেন তিনি। মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেওয়া যায় কি না, জানতে চেয়েছেন ফলকার। তাৎক্ষণিক জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে গণহত্যার বিচারের আগে তা সম্ভব নয়। নির্বাচনের সড়ক পথে যা নতুন প্রশ্ন। জবাবেও বিশেষত্ব। বিশ্লেষণের অনেক খোরাক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন