সামগ্রিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা দরকার। সেটা সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায়েই। হজ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, হজকে হজ মন্ত্রণালয়ের মৌসুমি কাজের আদল দেওয়া, কিছু এজেন্সির অবহেলা, দুর্নীতির একটা বিহিত অত্যন্ত প্রত্যাশিত। অন্তর্বর্তী সরকার সেই কাজটা শুরু করতে পারে। তারা না পারলে ভবিষ্যতে কেউ করবে বা পারবে, সেই আশা দুরূহ
ঘটনা এমন জায়গায় গিয়েই ঠেকেছে, পরিস্থিতির অনিবার্যতায় মসজিদ, কবরস্থান, এমনকি হজ ব্যবস্থাপনায়ও সংস্কার করতে হচ্ছে। ধর্মীয় বা গতানুগতিক বলে অগ্রাহ্য করার অবস্থা নেই। ‘আমাদের কাজ নয়’ বলে এড়িয়ে যায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। যথারীতি হজের ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর অংশ হিসেবে ২০২৫ সালে সরকারি খরচে কেউ হজে যেতে পারবে না। শুধু হজ ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাই সরকারি টাকায় হজে যেতে পারবেন। সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের সভায়। সব ঠিক থাকলে এ মাসের শেষদিকে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখতে হবে এবার হজের খরচ কত কমে।
নামাজ-রোজাসহ বিভিন্ন ইবাদতের মধ্যে একমাত্র হজের সঙ্গেই খরচের সম্পৃক্ততা। এর ব্যবস্থাপনায় অর্থের সঙ্গে রাজনীতি-কূটনীতিও প্রাসঙ্গিক। হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশৃঙ্খলার সঙ্গেও মানুষ অবগত। হজের সময় বিমান ভাড়া, মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, সময়মতো মুনাজ্জিম ভিসা না পাওয়াসহ কত যে আয়োজন। তা বছরে একবার হয় বলে যন্ত্রণাকাতর হয়ে কিছু বদদোয়া করেন মুসল্লিরা, মানুষ একপর্যায়ে এ কষ্টের কথা ভুলে যায়। এবার যেন সে ধরনের কিছু না হয়, সরকারের দিক থেকে আগাম সতর্কতা লক্ষণীয়। বিপরীতে রয়েছে লক্ষ্যচ্যুত ঘটানোর নমুনাও।
এবার হজের প্রাথমিক নিবন্ধন চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ-১ অধিশাখা সেই দৃষ্টে প্রস্তুতি নিচ্ছে। হজে গমনেচ্ছু প্রাক-নিবন্ধিত ব্যক্তিদের ৩ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধন নিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে প্রাক-নিবন্ধন ও প্রাথমিক নিবন্ধন যুগপৎভাবে করা যাবে। বাংলাদেশের হজ কোটা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী হজ পালনের সুযোগ পাবেন। তবে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে নিবন্ধন না করলে সুবিধাজনক জোনে তাঁবু বরাদ্দ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। গত বছর প্যাকেজের দাম কমিয়েও হজের কোটা না ভরার কাণ্ডকীর্তি দেখা গেছে। তিন দফা বাড়িয়ে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে হজের নিবন্ধনের সময়সীমা। কিন্তু শেষদিনে এসে দেখা যাচ্ছে, নিবন্ধন করেছেন প্রাপ্ত কোটার অর্ধেকের কিছু বেশি। তার ওপর খরচের ব্যাপার। এবার এর একটা আগাম সমাধান কাম্য।
হজ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত তথা অভিজ্ঞরা বলছেন—তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ-কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবার সার্ভিস চার্জ আগেভাগেই ফয়সালা করতে হবে। এর বাইরে পরিবহন ব্যয়, ভিসা ফির মতো বিষয় তো রয়েছেই। হজের অনেক খরচ কিন্তু নির্ধারিত। বিমান ভাড়া কমানোর সুযোগ থাকে না। যেটা সরকারের নির্ধারিত থাকে, সেটাই এখানে খরচ করতে হয়। সৌদি আরবে কিছু চার্জ আছে, যেগুলো সৌদি সরকার ঠিক করে দেয়। কম্প্রোমাইজ করা যায় মক্কা, মদিনার হোটেল ভাড়ায়। আর মিনা-আরাফায় তাঁবুর ক্যাটাগরিতে বলেকয়ে যদি কিছু করা যায়। হাজিদের কাছে হোটেলের মানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন হোটেল মক্কা, মদিনা, হারাম শরিফের কাছাকাছি। এসব ক্ষেত্রে দূরত্বটা একটু বাড়িয়ে খরচে ভারসাম্য আনা সম্ভব।
কোনো দেশ তাদের ইচ্ছামতো হজে লোক পাঠাতে পারে না। হজের জন্য যেহেতু সৌদি আরবকে বিশাল আয়োজন করতে হয়, হজের কোটা নির্দিষ্ট করাটাও তাই জরুরি হয়ে পড়ে। কোন দেশ থেকে কত মানুষ হজে যেতে পারবেন, তার কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে সৌদি আরবকে ক্রমাগত অনুরোধ করা হয় হজের কোটা বাড়ানোর। বেসরকারিভাবেও কিছু তদবির চালানো হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন বা ওআইসির একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হজের এ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওআইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে এক হাজারজন হজে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬-১৭ কোটি ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ হজ করতে যেতে পারার কথা। এভাবে ধরেই সংখ্যাটি কমবেশি হয়।
হজের মতো পবিত্র বিষয় নিয়ে দেশে যেভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং বেশিরভাগ মুসলমান বছরে একবার যান বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন না। প্রতিবাদ করেন না বলে তা আমলের বাইরে থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার অরাজনৈতিক সরকার। তাদের নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সরকারের মতো হজ থেকেও কামাই রোজগারের খাত তৈরি করে নেতা, কর্মী, আতিপাতি পোষার দরকার নেই। কিন্তু এর মধ্যেও ফেউ ঢোকার মতো ক্রিয়াকর্ম জমে গেছে। বিগত সরকারি দলের সুবিধাভোগী বিশেষ কিছু ব্যক্তি কাজটি সেরে ফেলেছেন ভেতরে ভেতরে। হজে যাওয়ার উদ্যোগের শুরু থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত হাজিদের হয়রানি এবং সরকারের দুর্নামের ছিদ্রগুলো তাদের রপ্ত করা। হজ ব্যবস্থাপনাকে কলঙ্কিত করতে হজ অ্যাসোসিয়েশন-হাবে প্রশাসক বসানো কাজটিতে তারা সফল হয়েছেন। হাব অচল থাকলে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমে বিঘ্ন না ঘটে পারে না। হজের মতো বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সরকারের একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি বেসরকারি সংগঠন। ভালো-মন্দ মিলিয়ে হাব সেই কাজটি করে আসছে। শাসন, প্রশাসন, প্রশাসক দিয়ে হজ ও হজযাত্রীদের সেবা দেওয়া অনেকটা অসম্ভব। হাবের কমিটি না থাকলে এতে হাজিরা প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। এরই মধ্যে এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় একটা বিপর্যয় বা গোলমাল বাধানোর আয়োজন বেশ আগুয়ান। যার বদনাম পুরোটাই পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। মোটা দাগে টার্গেটে পড়বে ধর্ম মন্ত্রণালয়। হজ ব্যবস্থাপনার কাজটি বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। আয়োজন ব্যাপক। হাতে সময় এখনো আছে। যার কাজ তাকে দিয়ে করানোর রাস্তা বের করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সচিব কমিটির প্রথম সভায় মন্ত্রণালয়ের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এ বছরের জন্য একটি হজনীতি ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে পরিবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হজনীতি হবে হজবান্ধব, সহনীয়। হজ ব্যবস্থাপনা সহজীকরণ ও ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের এখনই সময়। এ ক্ষেত্রে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমান ভাড়া নির্ধারণে আরও স্বচ্ছতা আনা যায়। হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য হজযাত্রী পরিবহন উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য হাব বছরের পর বছর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কুলাচ্ছে না। বরং হাব সিন্ডিকেটের অভিযোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে একটি মহল হাবের গলা টিপে ধরতে চাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি ভোটে হাবের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়ে আসছে। হজযাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে হজে যেতে পারে তার জন্য দেশে হাবের তদারকি টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে। মক্কা-মদিনায় হজযাত্রীদের সেবায়ও হাব টিমের কাজ রয়েছে। তাদের আরও কাজে না লাগিয়ে শাসন-প্রশাসনের চাক্কি ঘুরিয়ে সামনের হজকে ইস্যু করার কুচিন্তা অন্তর্বর্তী সরকারকে বাড়তি যন্ত্রণায় ফেলার একটি দাওয়াই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার ও দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি হজের ধর্মীয় তাৎপর্য ও পবিত্রতা বজায় রাখার স্বার্থে হজ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, গতিশীল ও জনবান্ধব করা আবশ্যক। ভয়ভীতি, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে হজযাত্রা সাবলীল ও সহজ রাখার প্রক্রিয়া খুব কঠিন নয়। সততার সঙ্গে টাকা আয় করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু হজযাত্রীদের জিম্মিদশায় ফেলে বাড়তি লাভের চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় ও হীন মানসিকতার পরিচায়ক।
প্রায় বছরই হজ মৌসুমে কোনো না কোনো জটিলতা তৈরির এ রোগ বন্ধ করা জরুরি। এবার জটিলতা তথা গোল বাধানোর চেষ্টাটি একটু আগাম শুরু হয়েছে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সামগ্রিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা দরকার। সেটা সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায়েই। হজ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, হজকে হজ মন্ত্রণালয়ের মৌসুমি কাজের আদল দেওয়া, কিছু এজেন্সির অবহেলা, দুর্নীতির একটা বিহিত অত্যন্ত প্রত্যাশিত। অন্তর্বর্তী সরকার সেই কাজটা শুরু করতে পারে। তা এ সরকার না পারলে ভবিষ্যতে কেউ করবে বা পারবে, সেই আশা দুরূহ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন