দেখতে দেখতে কীভাবে কেটে গেল শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতার এক মাস। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত-আহতদের মূল তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। দূর-দূরান্তে নেওয়া লাশের তথ্য সংগ্রহ চলছে। বার্তায় তিনি বলেন, মাত্র এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়েছে। তবে প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা। গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে তারা (জাতিসংঘ) এ দেশে এসেছে, কাজ শুরু করেছে।
এ দিনটিতেই গণমাধ্যমের কল্যাণে মানুষের জানা হয়েছে, শেখ হাসিনার সম্পর্কে ড. ইউনূসের মনমর্জি। দিনটিতে ঢাকায় নিজের সরকারি বাসভবনে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে বলেছেন। তাকে দেশে ফিরেয়ে এনে বিচারের কথাও বলেছেন; যা কিছুটা তথ্য, কিছুটা সতর্কবার্তা। বলেছেন, ‘…দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ ফেরত চাওয়ার আগপর্যন্ত তাকে যদি ভারত রাখতে চায় তাহলে তাকে চুপ থাকতে হবে। …ভারতে তার অবস্থান নিয়ে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। কারণ তাকে বিচারের আওতায় আনতে আমরা তাকে ফেরত চাই। ভারত থেকে মাঝেমধ্যে তিনি কথা বলছেন। এটা সমস্যা সৃষ্টি করছে। …যদি তিনি চুপ থাকতেন, তাহলে আমরা তাকে ভুলে যেতাম। মানুষ তাকে ভুলে যেত। তিনি তার নিজের জগতে থাকতেন। কিন্তু তিনি ভারতে বসে কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন; এটা কেউই পছন্দ করছে না। …সবাই এটা বুঝতে পারছে এবং আমরা বেশ দৃঢ়ভাবে বলেছি যে, তার চুপ থাকা উচিত। এটি আমাদের প্রতি একটি অবন্ধুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত; তাকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তিনি সেখান থেকে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এমন নয় যে, তিনি স্বাভাবিকভাবে সেখানে গেছেন। গণঅভ্যুত্থান ও জনরোষের কারণে তিনি সেখানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। …হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের সবাই ইসলামবাদী, ভারতকে এই ধারণা থেকে বের হয় আসতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত আনবে। …হ্যাঁ, তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে না। তিনি যে ধরনের নৃশংসতা করেছেন, তাকে এখানে সবার সামনে বিচার করতে হবে।’
ধরে আনা হবে, দেশে এনে বিচার করা হবে—এ ধরনের হুমকির চেয়েও শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে বলার পরামর্শ বা সতর্কতাটি বেশ মারাত্মক। বরাবরই তিনি চুপ থাকার মানুষ নন। কথা না বলে থাকতে পারেন না তিনি। তাও দু-চার কথা নয়, এক মিনিটের কথা কয়েক মিনিট বলে অভ্যস্ত তিনি। সেটাতেও থাকে নানান ভাব ও ভঙ্গি। অতিকথনের এ দোষে তাকে সমালোচিত কম হতে হয়নি ক্ষমতায় থাকতেও। আলোচিত সাক্ষাৎকারটিতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানান, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রস্তুত তার সরকার। আরও বলেন, ভারত সরকারের ধারণা আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাইকে ইসলামপন্থি মনে করার অবস্থান থেকে ভারতের সরে আসা দরকার বলেও মত তার। বাংলাদেশে সম্প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার অভিযোগ এবং এ ঘটনায় ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি ড. ইউনূস নিতান্তই একটি অজুহাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলেন, ঘটনাটি অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গণহত্যার বিচারের এক নম্বর টার্গেট শেখ হাসিনা। এর পরের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। যেখানে রয়েছে তার পারিষদের বড় বড় সদস্যের নাম। গণআন্দোলনকালে প্রতিটি হত্যা মামলায় তিনি এক নম্বর আসামি। এরপর ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কমন আসামি। সঙ্গে হত্যার এলাকার দায়িত্বরত পুলিশ, স্থানীয় এমপি অবশ্যই আসামি। এরপর থাকছে ওই এলাকার আতিপাতি নেতা এবং দলবাজ জনাকয়েক ব্যবসায়ীর নাম। মামলাগুলোর বাদী নিহতের কোনো স্বজন। আন্তর্জাতিক আদালতে হোক আর ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে হোক, হত্যা মামলার কিছু আসামির ভাগ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা দীর্ঘ কারাবাস ইত্যাদি অবধারিত।
৫ আগস্ট স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়। শেখ হাসিনার পলায়ন ও বিপ্লবের এক মাস পূর্তির দিনটিতে তারুণ্যের পদভারে দেশজুড়ে ফের প্রকম্পিত হয় রাজপথ। এ উপলক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘শহীদি মার্চ’ রাজধানীতে রূপ নেয় জনসমুদ্রে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে এ মার্চ শুরু হয়।
গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখার প্রত্যয় জানান মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা। এর নেতৃত্ব দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ‘শহীদি মার্চ’ নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কলাবাগান, মিরপুর রোড ধরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও রাজু ভাস্কর্য হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মার্চে অংশ নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হন। তাদের বেশিরভাগের হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। মিছিলে অংশ নিতে টিএসসিতে আসেন আন্দোলনে সন্তান হারানো অনেক বাবা-মাও। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের নাম লেখা পোস্টার হাতে এসেছেন অনেকেই। আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগসহ তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা-নির্যাতনের বিচার দাবিতে হয় নানা স্লোগান।
দিনটিতে আওয়ামী লীগকে কঠোর বার্তা দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও। গণহত্যার সম্পূর্ণ বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দল বা জোটের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, এরা রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না—এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। তবে তার আগে তারা পাবলিক প্রোগ্রাম করতে পারবে না। এ ছাড়া, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে কমিশন গঠনের কথাও জানান সরকারের এ উপদেষ্টা। গণভবনকে জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে গণমানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্তের কথাও জানান আসিফ মাহমুদ।
এ ছাড়া অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে একটি সম্মেলন করার কথাও জানান তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি এবং উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক নিয়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। ব্রিফিংয়ে অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে সম্মেলন, আহতদের চিকিৎসা, গণভবনকে জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর করাসহ উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়া নানা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানান সরকারের এ উপদেষ্টা।
এ দিনটিতেই ২০২৪ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এ নির্বাচন ছিল বিতর্কিত—জানিয়ে একযোগে পদত্যাগ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ তার গোটা কমিশন। নিজেরা কোনো দায় না নিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন সব দোষ পতিত হওয়া সরকারটির। যে যেদিক দিয়ে পারছেন দোষী করছেন শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠদের। সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলকের মতো সুবিধাভোগীরাও যত দোষ নন্দঘোষের ওপর চাপানোর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমেয়ে, বোন-ভাগ্নেসহ স্বজনদের দিকে ছুড়ছেন। তার ওপর বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যার দায়ও চাপানো হচ্ছে শেখ তাপস, শেখ সেলিমসহ পরিবারের কয়েকজনের ওপর। শেখ হাসিনার পতনের মাস পূর্তির দিনে ওই হত্যাকাণ্ডে গঠিত সেনা তদন্ত কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুল মতিনও কেঁদে কেঁদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। জানান, হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত বিডিআর সদস্যরা ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটনার আগে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিমসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, লে. কর্নেল শামসের ভূমিকা কী ছিল, সেটা তুলে ধরেন।
একই দিন বেআইনি আদেশ তামিল না করা এবং রাজনৈতিক কারণসহ নানা অজুহাতে সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত ৪৫০ সদস্য চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। গেল ১৫ বছরে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রায় ৪৫০ অফিসার ছিলেন চাকরিচ্যুতির তালিকায়, যেখানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে সামান্য সৈনিকও বাদ যাননি। ক্ষণগণনায় আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাস পূর্তির দিনে এত আয়োজন মোটেই এমনি এমনি নয়। ইতিহাসের কী নির্মমতা! কোথাও দেখা মিলছে না ক্ষমতাকালের দাপুটে মুখগুলোকে। রীতিমতো হাওয়া রাজনীতির মাঠ ও মিডিয়া কাঁপিয়ে বেড়ানো হেভিওয়েটরা। টুঁ-শব্দ নেই তাদের। টুকটাক কথা বলছিলেন শেখ হাসিনাই। ভারতের গণমাধ্যমে আসা বক্তব্যগুলো যে সরকার ভালোভাবে নিচ্ছে না—তা পরিষ্কার ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারে। শেখ হাসিনা ভারতে এই মুহূর্তে ঠিক কীসের ভিত্তিতে আছেন—সেই প্রশ্নের ঢোলে টোকা দেওয়া হচ্ছে বারবার। অথচ পঁচাত্তর-ট্র্যাজেডির পর শেখ হাসিনার টানা কয়েক বছর ভারতে অবস্থান নিয়ে এভাবে কথা ওঠেনি। একেই বলে সময়ের ফোঁড়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন