বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় ফ্রন্টলাইনে নেমে গেছে সেনাবাহিনী। সঙ্গে কোনো কোনো দুর্গত এলাকায় নৌ-বিমানবাহিনী সদস্যদেরও কর্মতৎপরতা। নেমেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবিও। পুলিশ তো আছেই। আক্রান্ত বা দুর্গতদের সমান্তরালে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের একটি সুযোগও এ উপলক্ষটি। এসব বাহিনীর ইমেজ ও জনসম্পৃক্ততা পরখ করার জন্য গত দু-তিন দিনের মাঠচিত্র কিছু বার্তা দিচ্ছে। ঠিক এ সময়টাতেই গণহত্যাকারী, গণহত্যা সমর্থনকারী, গণহত্যায় উসকানিদাতা, নমুনা বুঝে সুশীল ভেকধারী হয়ে ওঠাদের জন্য একটা কঠিন সন্ধিক্ষণ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত জুলাই ও আগস্ট মাসের শুরুতে দেশজুড়ে সংঘটিত নৃশংসতার ঘটনাগুলো তদন্তে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় বেশ কর্মব্যস্ত। তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রোরি মুঙ্গেভেন। তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধানও। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস গত কদিন থেকেই এ নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানো একটি মোটাদাগের ঘটনা।
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের দিন-কয়েকের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন এবং বিক্ষোভকারীদের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের সময় শিক্ষার্থীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ভলকার তুর্ক এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানান। ড. ইউনূসের সঙ্গে ফোনালাপের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। এ ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়ার কথাও বলেন। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিসংঘের এ পদক্ষেপ। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের তদন্তের আওতায় বিগত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব এমনকি আনসারও বাদ পড়ছে না। কার কী কাফফারা গুনতে হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।
ক্ষমতায় থাকলে দম্ভের সঙ্গে অনেক কিছু করা যায়। তা মাত্রাগতভাবে বেশি করলে কখনো কখনো চরম পরিণতিও ভুগতে হয়। দিতে হয় কঠিন মাশুল। পরিবার-পরিজনকেও বাকি জীবন কাফফারা গুনতে হয়। সেই আতঙ্কে বাহিনীপ্রধানসহ পুলিশের মহাপরাক্রমশালী কর্মকর্তাদের হাল অবস্থা গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষেরও জানা। দেয়াল টপকে, লুঙ্গি ড্যান্সে, হেলিকপ্টারে বা রিকশায় সাধারণ মানুষ সেজে পালানোর কিছু ঘটনাও প্রকাশ হয়েছে। একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনার ভারতে চম্পট দেওয়ার পর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, আতিকুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ বাঘা বাঘা পুলিশ কর্মকর্তার গুরুচরণ দশা এবং প্রাণভয়ে পালানোর কথা আর গোপন নেই। বর্ডার গার্ড বিজিবি এর কিছু আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সেনাবাহিনী ‘নো ফায়ার’ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আরও ঢের আগেই। পুলিশ-র্যাবের বিশেষ কয়েক কর্মকর্তার হম্বিতম্বি চলতে থাকে তখনো। অথচ ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে ‘জনগণের ওপর গুলি নয়’—বার্তাটি গোপন থাকেনি। অতি উৎসাহী দলবাজ, গোঁয়ারগোবিন্দ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠের অবস্থা জানার বোধও যেন হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার কর্মকর্তাদের বৈঠক নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও প্রতিরক্ষাবিষয়ক অনেক বছরের পুরোনো চর্চার কারণে ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশনস-আইএসপিআর থেকে তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিবেদন করেনি। পরে সংবাদ করলেও বৈঠকের ফল খুব একটা প্রকাশ করতে পারেনি। তবে দেশের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সেখানে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনের পাশে দাঁড়াবে।’ ওই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সন্তোষজনক না হওয়ায় সংস্থাটি গণমাধ্যমকে, বিশেষত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞপ্তির ‘জনগণের পাশে দাঁড়ানো’ অংশটি ব্যবহার করতে নিষেধ করে। সব গণমাধ্যম না হলেও বেশ কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ নির্দেশ পালন করে ‘জনগণের পাশে দাঁড়ানো’ শব্দগুলো তাদের ব্রেকিং নিউজ টিকার থেকে মুছে দেয়। এতে সংবাদটির প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেশি জন্মে। সেইসঙ্গে যে যা বোঝার বুঝে নেন। পরের ঘটনাবলি জানাজানি হতে সময় লাগেনি। এসবের মধ্য দিয়ে সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনীর কপালে লাগানো কয়েক দিনের কালিমা দূর হতে সময় লাগেনি। দিন শেষে জনগণ সেনাবাহিনীকে ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’ নামেই বরণ করে নেয়। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি সেই সুযোগ পায়নি।
জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক যে কোনো তদন্তেই তা ঝরঝরে হয়ে আসবে। সেই তদন্তের আগেই পুলিশের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। সেনা সহায়তায় জনতার সঙ্গে মিলেমিশে চলার ওয়াদা দিয়ে থানায় থানায় ফিরলেও আতঙ্কে পুলিশ সদস্যরা। ক্ষতবিক্ষত, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া পুলিশকে কাজে ফেরানো দস্তুরমতো একটি উদ্ধার প্রক্রিয়া। এর মাঝে আবার ধর্মঘটী পুলিশ সদস্যদেরও নিবৃত্ত করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশব্যাপী পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার পর বেশ কিছু দাবিতে গত ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন। সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করানোর কাজটি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে ব্যাপক প্রাণহানি এবং পরে থানায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলার জেরে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতিতে ছিল পুলিশ প্রশাসনের কর্মচারীরা। তারাও কাজে ফিরেছে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব ফিরে আসা ছোটর মধ্যেও একটি বড় ঘটনা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে ১২ আগস্ট সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তাদের দায়িত্ব পালন দৃষ্টি কেড়েছে সবার। ৫ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত তাদের কাজটি করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক দমনপীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কোটার আন্দোলন গিয়ে ঠেকে একদফার সরকার পতনের আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। সেইসঙ্গে ছাত্র-জনতার তোপ। থানা ও ট্রাফিক স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যা। ছাত্র-জনতার রোষের মুখে পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও সরকার বা আওয়ামীঘেঁষা কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার আক্রান্ত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুনিয়র সদস্যদের ফেলে পালিয়ে যান। সেদিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বুঝেও শক্তি প্রয়োগে মনোযোগী ছিলেন। পরে আর ডানে-বামে না তাকিয়ে নিজেরা যে যেভাবে পেরেছেন পালিয়েছেন। সহকর্মী বা সাধারণ পুলিশ সদস্যদের কী হবে, তা ভাবার ফুরসতও পাননি। এখন প্রায়শ্চিত্তে ভুগছেন। কাফফারা দিচ্ছেন। জীবনে আর দলীয় লাঠিয়াল হবেন না বলে অঙ্গীকার করেও বিশ্বাস ফেরানো যাচ্ছে না। সদস্যদের মনোবল ও আস্থা ফেরাতে আইজিপি ময়নুল ইসলামের বেশ কিছু নির্দেশনায়ও কূলকিনারা মিলছে না।
বিজিবির অবস্থা র্যাব-পুলিশের মতো না হলেও তেমন সুখকর নয়। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সীমান্ত জেলা কুমিল্লা, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী বন্যাদুর্গত এলাকার অসহায় মানুষদের উদ্ধার কার্যক্রম, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এবং নদীরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজিবি। এ নিয়ে বিজিবির জনসংযোগ বিভাগকে দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হচ্ছে বাহিনীটির খাটাখাটুনির কথা। বিজিবি সেনানিয়ন্ত্রিত বাহিনী বিধায় ধারণা করা যায়, এ অবস্থা উতরে যাবে তারা। কিন্তু তরতাজা বা টাটকা ঘটনা বিবেচনায় দেশের সীমান্তের বদলে বিজিবি সদস্যদের শাহবাগ বা শনির আখড়া সীমানার তৎপরতা মানুষের মন থেকে মুছতে সময় লাগাই স্বাভাবিক। সেনাবাহিনী সে ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম নয়, ভাগ্যবানও। তার ওপর ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার আশা-ভরসাস্থলও হয়ে উঠেছে। যার আরেক ঝলক নমুনা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের বৃহস্পতিবারের মতবিনিময় সভা। ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত এ সভায় সেনাসদর ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির হোসেন, এ কে আজাদ, মো. জসিম উদ্দিন, তপন চৌধুরী, আশরাফ আহমেদ, খন্দকার রফিকুল ইসলাম ও নাসের এজাজ বিজয়।
সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এবারের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে সময়োচিত ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন অক্ষুণ্ন রাখাসহ আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করায় সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। শিল্পকলকারখানা ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তা প্রদান, চাঁদাবাজি বন্ধ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনসহ বিবিধ কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনী পাশে থাকবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার এ আশ্বাসে বিশ্বাস পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এটাই বাস্তবতা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন