মোনায়েম সরকার
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে বিতর্ক

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে বিতর্ক

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রায়ই বলছেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা না হলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। উল্টো খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতারাই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন। দুই মন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন, নির্বাচন করতে পারবেন না। আবার অন্য দুই মন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়া এখন রাজনীতিও করতে পারবেন না। তবে আজ আমরা দৃষ্টি দিতে পারি দুই দলের সমঝোতার পথে কাঁটা হয়ে থাকা ভিন্ন একটি বিষয়ে। সেটা হলো খালেদা জিয়ার জন্মদিন।

১৯৯১ সালে মন্ত্রিসভা গঠন করার সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার যে জন্মবৃত্তান্ত জাতির কাছে প্রকাশ করা হয়েছিল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও দৈনিক বাংলার মাধ্যমে, তাতে আমরা জেনেছিলাম তার জন্মতারিখ ১৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল। ক্ষমতায় থাকার সময় হঠাৎ করে দৈনিক বাংলার এক সাংবাদিক লিখলেন, খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫। খালেদা জিয়ার আরও দুটি জন্মদিনের তথ্যও আছে।

আমরা যারা বিভিন্ন ব্যক্তির জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকিবহাল নই, তারা বিপাকে পড়ে গিয়েছি দেশের একজন প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীর একাধিক জন্মদিনের তথ্যে। জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সাধারণত তা আদালতে হাকিমের সামনে হলফ করে সংশোধন করতে হয়, ইংরেজিতে যাকে এফিডেভিট বলে। কিন্তু সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী জন্মতারিখ ঠিক করার জন্য বাংলাদেশের কোনো আদালতে এফিডেভিট করেছেন বলে দেশবাসী জানে না। হতে পারে ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা পছন্দমতো জন্মতারিখ বানিয়ে নিতে পারেন। অথবা তাদের একাধিক দিনে জন্ম হয় বলে একাধিক জন্মদিন থাকে। অথবা তাদের আদালতে এফিডেভিট করতে হয় না। নিজেদের তারা আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন (অন্তত বাংলাদেশে)। অথবা রাজনৈতিক মতলববাজি থেকে এমনও ধারণা হতে পারে, জন্মদিন নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে তামাশা করা যেতে পারে। এ ধারণাগুলোর মধ্যে খালেদা জিয়া এবং তার দলের আচরণ কোনটা সংগতিপূর্ণ, সে রহস্য এখন পর্যন্ত ভেদ করা সম্ভব হয়নি।

খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে কয়েক বছর ধরে যে তামাশা চলছে, তার অন্য কোনো মাজেজা উদ্ধার করা না গেলেও রাজনৈতিক তাৎপর্যটি আমাদের অনেকেরই বুঝতে কষ্ট হয়নি। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন বানানোয় বিএনপির কতগুলো রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে। একটি হলো, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবস। ওইদিন খালেদা জিয়ার জন্মদিবস থাকলে বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই নেত্রীর জন্মদিন পালন করবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনোরকম আলোচনা (পক্ষে-বিপক্ষে যা-ই হোক) করার দায় থেকে বিএনপি মুক্ত থাকতে পারে। জাতীয় শোক দিবসে আমোদ-আহ্লাদ করার একটা উপলক্ষও পাওয়া যায়। বিএনপি একটি প্রভাবশালী দল, যা অরাজনৈতিকভাবে সৃষ্টি হয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দলটি যে রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে, সেটি মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সামরিক স্বৈরাচার ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মৌলিকভাবে গণতন্ত্রবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধারা, তারই পরিপূরক হিসেবে বিএনপির জন্ম হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পরও নিষ্ঠার সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্ব এ ধারাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে রাজনীতির এ ধারার পুনর্জন্ম হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে। এর সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি বিএনপি। সুতরাং বিএনপির মতো একটি দল যদি ১৫ আগস্টে তার নেত্রীর জন্মদিন পালন করে প্রতিবছর, তবে দেশের এক বড় অংশকে রাজনৈতিকভাবে আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ থেকে বিরত রাখা যায়। এভাবে রাজনৈতিক হত্যার সমর্থনকারী ধারণাকে প্রতিবছর নতুন করে সজীব করা যায়। বিভেদের এ ধারাটির জন্মদাতা বিএনপি। ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনের রাজনৈতিক কৌশল যার মাথা থেকেই বের হোক, তিনি যে বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষের মনোজগৎ বুঝতে পারঙ্গম—সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধিতা তো কোনোভাবেই দূর হবে না।

জন্মদিন নিয়ে এ মশকরা অনেক খ্যাতিমানদেরও সমর্থন পেয়েছে। তবে যারা সমর্থন করেছেন, তারা বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন কি? এ ঘটনার পেছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে, তার অসততার গুরুত্ব জাতীয় রাজনীতিতে কি কম? যে দল ভিন্নমতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এমন এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে পারে, জাতীয় রাজনীতিতে সে দলটি কোনো সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করছে কিনা, এ প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়। জাতীয় রাজনীতিতে অসুস্থতার এই বীজ রোপিত হয়ে প্রতিবছর যে রাজনীতিকে কলুষিত করছে, বিভক্ত করছে, সমঝোতা ও সহযোগিতার পরিবেশের পথে স্থায়ী প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে রাখছে, তা ভাবারও গরজ বোধ করা হচ্ছে না। এর খেসারত দেশবাসীকেই দিতে হচ্ছে।

বিএনপি রাজনীতির মধ্যে এক ধরনের অস্থির অসততা কাজ করে। দলটির জন্ম অরাজনৈতিক পন্থায় এবং দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও রহস্যময় জন্মের লেগাসি (খালেদা জিয়ার জন্মতারিখের মতোই) আজও বহন করে চলেছে বিএনপি নেতৃত্ব। স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতি থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি দলটির নেতৃত্ব। সেই পাকিস্তান যুগের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মতোই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও মনে করেন, ‘বিএনপি ছাড়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কেউ রক্ষা করতে পারবে না। বিএনপিই একমাত্র দেশপ্রেমিক দল।’ অর্থাৎ প্রকারান্তরে অন্য সব দলকে অদেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করার যে ঔদ্ধত্য দেখানো হয়, তারও ন্যায্য প্রতিবাদ করা হয় না। অন্য দলের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক পার্থক্য আছে এবং থাকবে; ভিন্নমত থাকবে নানান জাতীয় ইস্যুতে কিন্তু অন্য সব দল অদেশপ্রেমিক এবং বিএনপি দেশপ্রেমের সোল এজেন্ট, এমন তত্ত্ব অতীতে হয়তো চলেছে, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে যে চলবে না, সেটা বিএনপি নেতৃত্ব যদি না বোঝে, তবে বলতেই হবে রাজনৈতিক মূর্খামিকে প্রশ্রয় দেওয়ার নীতিতে তারা অবিচল। আসা যাক খালেদা জিয়ার দেশ বিক্রি তত্ত্বে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি প্রথমে বলেছিলেন, দেশ বিক্রি করে ফেলেছে সরকার। কিছুদিন পর তিনি সুর পাল্টে বললেন, দেশ বিক্রির নীলনকশা তৈরি করে ফেলেছে সরকার। তারপর বললেন, দেশ বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সরকার দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশ বিক্রি নিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়া নিজেই কি তার বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করেননি? যিনি দেশের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যিনি ভবিষ্যতে আবারও নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, (যদি জনগণ ভোট দিয়ে তার দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী করে) তার রাজনৈতিক প্রচারণা যদি অসার হয়, তবে তার এবং তার দলের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে কীভাবে? আমাদের দুর্ভাগ্য, খালেদা জিয়া যা-ই করুন না কেন, তার সমর্থকগোষ্ঠী তা-ই সমর্থন করে দ্বিধাহীনচিত্তে।

আমাদের দেশের বিভেদাত্মক রাজনীতির এটি একটি দিক যে, আওয়ামী লীগের কোনো ছোট খারাপ কাজও বড় করে দেখা এবং বিএনপির বড় খারাপকে না দেখার প্রবণতা অনেকের মধ্যে প্রবল। কিন্তু সরকারের কাছে যেমন, তেমনি বিরোধী দলের কাছেও দায়িত্বশীল আচরণ সাধারণভাবে প্রত্যাশিত। বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন দলকে যেমন দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়, বিরোধী দলকেও তা করতে হয়। সংসদীয় পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল মিলেই সংসদ এবং সংসদই সরকার গঠন করে। অথচ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে সবসময়ই অনীহা। বিএনপি সরকারে থাকতেও ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়ার সংসদে উপস্থিতি কম ছিল। এ যাবৎ যত ধরনের সরকার পদ্ধতি চালু হয়েছে বিশ্বে, তার মধ্যে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এবং সংসদ সদস্যদের কর্মকাণ্ড, আচরণ ও রাজনীতির প্রতি জনসাধারণের বেশি নজর রাখা সম্ভব, মূল্যায়ন সম্ভব। এর প্রতিফলন ঘটে পরবর্তী নির্বাচনে। প্রতিটি দলকে নীরবে-নিভৃতে পর্যবেক্ষণ করে জনসাধারণ ভোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

বেগম খালেদা জিয়া মনে করতে পারেন, বাংলাদেশের জনসাধারণ এখনো পঞ্চাশের দশকের মুসলিম লীগ শাসিত অবস্থায় রয়ে গেছে। তাতে তিনি রাজনৈতিক তৃপ্তিও পেতে পারেন। কিন্তু অবাধ তথ্যপ্রবাহ যুগের জনসাধারণ যে মুসলিম লীগ তো নয়ই; বিএনপি, এমনকি আওয়ামী লীগেরও অন্ধ সমর্থক নয়—এ সত্য খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতৃত্ব যত দ্রুত উপলব্ধি করেন, রাজনীতির জন্য, দেশবাসীর জন্য ততই মঙ্গল। দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুতে বিএনপিকেই তার এতদিনের অনুসৃত এসব ভুল নীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিতে হবে আগে।

লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক, মহাপরিচালক, বিএফডিআর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মারধরের শিকার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে দেখতে হাসপাতালে পলক

চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড

সারা দেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট

সাতকানিয়ায় প্রতীমা ভাংচুরে যুক্তদের বিচারের দাবি পূজা উদযাপন পরিষদের

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে বেধড়ক পেটালেন আ.লীগ নেতা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, পরীক্ষার রুটিনে পরিবর্তন আনল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকায় কাতারের আমিরের নামে সড়ক ও পার্ক

ইরানে হামলার খবর এক দিন আগেই যেভাবে পেল যুক্তরাষ্ট্র

গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক ২০২৪ / বিশ্বকে বাঁচাতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধের দাবি তরুণদের

বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভেঙে ঢুকে গেল বাস, নিহত প্রকৌশলী

১০

স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

১১

জুভেন্তাসের বিরুদ্ধে বড় জয় রোনালদোর

১২

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি নির্বাচন / ভোট শেষে গণ্ডগোলের আশঙ্কা

১৩

ছাত্রলীগ নেতার পর এবার আ.লীগ নেতার ভিডিও ভাইরাল

১৪

কেন ৪৪ দিন ধরে চলবে ভারতের নির্বাচন

১৫

সরকারের প্রত্যেকটি অন্যায়ের রেকর্ড আছে : রিজভী

১৬

স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: প্রতিমন্ত্রী

১৭

শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে

১৮

ইসরায়েলি হামলার পর ইরান এখন কী করবে

১৯

ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য করার প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো

২০
*/ ?>
X