
কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল হজ নিবন্ধনের শেষ দিন। তবে এ দিনে এসেও হজযাত্রীর সংখ্যার লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ফলে নতুন করে নিবন্ধনের সময় আরও পাঁচ দিন বাড়িয়ে ২১ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এরপর আর সময় বাড়ানো হবে না বলেও জানানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থায় সর্বমোট ১ লাখ ৯ হাজার ৬১৯ জন হজযাত্রী নিবন্ধন করেন। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী পাঠানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও হজযাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির হজ গমনেচ্ছুদের কেউ কেউ খরচের ভয়ে নিবন্ধন করতে না পেরে আক্ষেপ করছেন। কারণ হজে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই তারা প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হজ অনুবিভাগ) মো. মতিউল ইসলাম বলেন, হজের কোটা পূরণ না হওয়ায় আগামী ২১ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছি। আশা করছি এই সময়ের মধ্যেই কোটা পূরণ হবে। তবে আপাতত হজের খরচ কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
এদিকে হজের ব্যয় বাড়ায় হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। গত বুধবার ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক বৈঠক থেকে এ সুপারিশ করা হয়।
এর আগে হজের খরচ কমাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে একটি রিটও করা হয়েছিল। রিটে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও যে কোনো এয়ারলাইন্সের টিকিটে হজে যাওয়ার অনুমতি দিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়। গত ১২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আশরাফ-উজ-জামান জনস্বার্থে এ রিট করেন। এর আগে হজের প্যাকেজ সংশোধন করে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন তিনি।
পরে ঘোষিত হজের প্যাকেজ মূল্য কমাতে গত ১৫ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে করা রিটের শুনানি মুলতবি করেন এবং খরচ কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে বলেন।
আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, হজের প্যাকেজ ঘোষণা করা সরকারের পলিসি ডিসিশন। এই বিষয়ে আদালত আদেশ দিতে পারেন না। তখন আদালত বলেন, এর সঙ্গে জনস্বার্থ জড়িত, তাই এ বিষয়ে শুনতে বাধা নেই। পরে আদালত এই রিট আবেদনের শুনানি মুলতবি করেন।
কর্মকর্তারা বলেন, হজের খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির হজযাত্রীরা প্রাক-নিবন্ধন করলেও হজে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে পারেননি। তাই কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও কোটা পূরণের হজযাত্রী জোগাড় করতে পারেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এদিকে গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সর্বমোট নিবন্ধন করা ১ লাখ ৯ হাজার ৬১৯ জনের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ হাজার ৬৮৩ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯৯ হাজার ৯৩৬ জন রয়েছেন। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জনকে হজে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ডলার দাম, বিমানের খরচ, মিনা ও আরাফায় তাঁবুর খরচ বেড়ে যাওয়ায় হজের খরচ মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
হজের খরচ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর বিমান খরচ বেড়েছে ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। তাঁবুর সার্ভিস চার্জ বেড়েছে ৯৯ হাজার ৩৯৪ টাকা। এ দুই খাতের বাড়তি খরচ এবং রিয়ালের দাম বৃদ্ধির ফলেই এবার হজের খরচ বেড়েছে। তবে কোনো কোনো খাতে এবার আগের বছরের তুলনায় খরচ কিছুটা কমেছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের হজযাত্রী নিবন্ধন শুরু হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল নিবন্ধনের সর্বশেষ তারিখ। কিন্তু হজযাত্রী নিবন্ধন আশানুরূপ না হওয়ায় আরও পাঁচ দিন বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি করা হয়। তবুও হজ নিবন্ধনের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। ফলে নতুন করে আবারও সময় বাড়িয়ে ১৬ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এরপর আরও এক দফা সময় বাড়িয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য অফিসার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, গত বছর রিয়ালের মূল্য ছিল ২৪ টাকা, সেটি এবার ৩০ টাকারও বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক কারণেও খরচ বেড়েছে। এ কারণেই অনেকে প্রাক-নিবন্ধন করেও এখন আর নিবন্ধন করছেন না।
তিনি আরও বলেন, সৌদি আরবের মিনার তাঁবুর সি ক্যাটাগরির মূল্য অনুসারে সরকারি প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে। মিনার তাঁবুর অবস্থান সংক্রান্ত ক্যাটাগরি গ্রহণের ভিত্তিতে বেসরকারি এজেন্সিগুলো সরকারি প্যাকজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজ নিজ হজ প্যাকেজ নির্ধারণ করবে।
এ বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা নির্ধারণ করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। গত বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজ ছিল ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ টাকা। অবশ্য হজের পর সরকারি ব্যবস্থাপনার হাজিদের ৪৭ হাজার ৭২৬ টাকা ফেরত দিয়েছে সরকার। অর্থাৎ গত বছর ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৪ টাকায় হজ করেছেন সরকারি ব্যবস্থাপনার হাজিরা। সে হিসাবে এবার গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০৪ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কোরবানি ছাড়াই সর্বনিম্ন ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকার হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। গত বছর যা ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এবার দেড় লাখ টাকা বেড়েছে।
হজ প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিমান ভাড়া বেড়েছে ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। সেইসঙ্গে বেড়েছে রিয়ালের দাম। মুয়াল্লিম ফি অর্থাৎ মিনা ও আরাফাতে তাঁবুর সার্ভিস চার্জ বেড়েছে ৯৯ হাজার ৩৯৪ টাকা। তবে এবার জেদ্দা-মক্কা-মদিনা ও আল মাশায়ের বাস ভাড়া কমেছে ৭ হাজার ৪৭৩ টাকা। মিনা ও মক্কার বাস ভাড়া কমেছে ১ হাজার ৪৯ টাকা। গত বছর এ খরচ ছিল মাত্র ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা। এবার হাজিদের গুনতে হবে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা। বিপুল পরিমাণ এই বাড়তি ব্যয়ই হজের টোটাল প্যাকেজের খরচ বাড়িয়েছে। মিনা-আরাফা, আরাফা-মুজদালিফায় উন্নতমানের বাস বা ট্রেন ভাড়া বেড়েছে ১২ হাজার ৪৩ টাকা।
এবার হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) ঘোষণা অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীদের জন্য একটি প্যাকেজ করা হয়েছে। এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। এ ছাড়া হাজিদের কোরবানির খরচ আলাদা নিতে হবে। অবশ্য প্রত্যেক এজেন্সি হজযাত্রীদের চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন প্যাকেজ করতে পারবে বলেও জানিয়েছে হাব।
গত ২ ফেব্রুয়ারি হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেছিলেন, এবার বিমান ভাড়া বৃদ্ধি ও বিমানের কনভারশন রেট কমাতে না পারায় হজের প্যাকেজ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে যেসব হজযাত্রী ৩০ হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধন করছেন, তারা ভেবেছেন ৪ লাখ কিংবা সাড়ে ৪ লাখ টাকায় হজে যেতে পারবেন। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে হজে যেতে হচ্ছে। আমরা বিমান ভাড়া যৌক্তিক করার দাবি জানাচ্ছি।