বিক্ষোভে উত্তাল রাবি, চার দফা শিক্ষার্থীদের

রোববার সন্ধ্যার পর রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।
রোববার সন্ধ্যার পর রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।ছবি : সংগৃহীত

স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের পরদিন গতকাল রোববার দিনভর নানা কর্মসূচি পালনের পর বিকেল ৪টার দিকে চার দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু সন্ধ্যার পর আবারও শুরু হয় অস্থিরতা। রাত পৌনে ৮টার দিকে চারুকলার পাশে রেললাইনে অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এতে রাজশাহী-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসের অদূরে চারুকলা অনুষদের সামনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রেললাইন ও আশপাশে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা রেললাইন অবরোধ করলে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে রাজশাহীগামী মধুমতী ট্রেনটি রাজশাহী নগরীর অদূরে খড়খড়ি

এলাকায় আটকা পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজশাহী থেকে বিভিন্ন রুটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার কালবেলাকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকেই সতর্ক করেছিল। তারা আমাদের ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রাজশাহী থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যাবে না।’

মতিহার থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রেললাইনে আগুন দেওয়ার খবর জানতে পেরে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।’

গত শনিবার সন্ধ্যায় বিনোদপুর বাজারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল দিনভর নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। হামলার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি তারা সিনেট ভবনের সামনে প্রায় তিন ঘণ্টা উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। স্থানীয়দের হামলার ঘটনায় অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম। পরে চার দফা দাবি জানিয়ে কর্মসূচি আপাতত স্থগিতের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। পরে উপাচার্যের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন।

শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল—ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় ও যাবতীয় ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, হামলাকারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ প্রশাসনের দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা ও প্রক্টরিয়াল বডিকে অপসারণ করতে হবে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা মামলায় মারধর, হামলা ও গুরুতর জখম করার অভিযোগ আনা হয়েছে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নাম মো. তসলিম আলী পিটার। তিনি নগরীর খোঁজাপুর এলাকার মৃত মো. মতলেব শেখের ছেলে।

সার্বিক বিষয়ে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘স্থানীয়দের হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। ওই ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের যে ধরনের ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেটি করতে পারেনি। ফলে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তবে রামেক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জরুরি ভিত্তিতে তাদের সেবা দেওয়ার জন্য। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি দিলে আমি সেটি নিয়ে কাজ করব। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ চলমান রয়েছে।’

এর আগে গত শনিবার সন্ধ্যায় বগুড়া থেকে ‘মোহাম্মদ’ নামে একটি যাত্রীবাহী বাসে রাজশাহী পৌঁছান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আলামিন আকাশ। এ সময় সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গাড়ির চালক শরিফুল ও হেলপার রিপনের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে এসে আবারও সুপারভাইজারের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা শুরু হলে স্থানীয় এক দোকানদার এসে ওই শিক্ষার্থীর ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে স্থানীয় দোকানদারদের ওপর পাল্টা চড়াও হন। পরে স্থানীয়রাও একজোট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে অন্তত ২ শতাধিক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি সাত প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

সংঘর্ষে আহত ৮৯ জন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে ৮৬ জনই শিক্ষার্থী। অন্য তিনজনের মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য ও একজন সাধারণ পথচারী। এর মধ্যে ৪৫ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি ৪৪ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন। তবে মো. রাকিব নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক মাস্টার্সের শিক্ষার্থীকে রাতেই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে। তার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক বলে আইসিইউ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামলা জানিয়েছেন। আহতদের মধ্যে সাতজন চোখে আঘাত পেয়েছেন। এর মধ্যে একজন রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েছেন। বাকিদের চোখে ইটের আঘাত লেগেছে। কয়েকজনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানায় রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

রোববার দিনভর কর্মসূচি :

সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এতে জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডেসহ কয়েকজন কর্মকর্তা আটকে পড়েন। এরপর সকাল ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। ‘আমার ভাই আহত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’, ‘পুলিশের হামলার, বিচার চাই বিচার চাই’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’ স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে শুরু হওয়া চলমান বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। পরে সেখানে উপাচার্যসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। উপাচার্য বারবার কথা বলার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। পরে দুপুর ১টায় উপাচার্যকে শিক্ষার্থীরা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশের মাঠ যান। এখানেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের কোনো সংলাপ হয়নি। ফলে একটু পর উপাচার্য চলে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তাকে সিনেটের পাদদেশে অবরুদ্ধ করেন। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা থাকার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে উপাচার্যকে নিরাপত্তা দিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কথা বলতে শুরু করলে ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়ে চড়-থাপ্পড় দেন। এ সময় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com