
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারকে স্বাগত জানিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বলেছেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা গেলেই সংবিধানের সঠিক মূল্যায়ন হবে। এটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে কাজ করলে একে অন্যের প্রতি আস্থা তৈরি হবে। এর ফলে যে কোনো ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তিনি জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার বা আইনি মামলা এড়ানোর মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন। গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য অংশীদারত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় এ পরামর্শ দেন ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী। গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন অ্যান-মেরি। শনিবার তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
বিদেশি পর্যবেক্ষক রাখার সিদ্ধান্ত জাতীয় নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সহায়ক হবে মন্তব্য করে ব্রিটিশ এ প্রতিমন্ত্রী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে তার দেশের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের কৌশল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিকে কোনো সামরিক জোটের সঙ্গে নেই। বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক তথা অর্থনৈতিক আইপিসে থাকার বিষয়ে নীতিগতভাবে অটল সিদ্ধান্তে রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব শাব্বির আহমেদ চৌধুরীর সঞ্চালনতায় প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার ঢাকা ও লন্ডনের মধ্যে ফের বিমান চালুর বিষয়ে ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: এর আগে দুপুরে অ্যান মেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীকে মোমেন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তা না করার জন্য আশ্বস্ত করে বলেন, বর্তমান সরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইতোমধ্যে স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী সবকিছু শুনে বলেছেন, গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকতে পারে। এ সময় মন্ত্রী বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়পরায়ণতার কথা তুলে ধরে ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, তাদের কোনো দুর্বলতা থাকলে বাংলাদেশ থেকে শিখতে পারেন।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে এক টুইটবার্তায় ট্রেভেলিয়ান বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমাদের সমর্থনের বিষয়েও জানিয়েছি।’
জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর: ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সমঝোতা চুক্তি (একর্ড) স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যের পক্ষে অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
শাহরিয়ার আলম বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে কপ-২৬ ও কপ-২৭ এ গৃহীত লস অ্যান্ড ডেমেজসহ সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করবে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠিত ‘অ্যাডাপটেশন অ্যাকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আন্তঃমন্ত্রণালয় গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান-ন্যাপ (২০২৩-২০৫০) বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক শাখার মহাপরিচালক ফাইয়াজ মুরশিদ কাজীর পরিচালনায় বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার ও ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ; বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, ইইউর ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, জিসিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রফেসর ড. প্যাট্রিক ভারকুইজেন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বাংলাদেশ ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক এবং গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর সেলিমুল হক, জিসির বিশিষ্ট ফেলো আবুল কালাম আজাদসহ আরও অনেকে অংশ নেন।
রোহিঙ্গাদের দেখতে আসছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, তিনি ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, শিগগিরই রোহিঙ্গাদের অবস্থান দেখতে মিয়ানমার থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করবেন।
ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারে সেনাশাসন আসার পরও দুদেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাখাইনের পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও আসিয়ানের আটটি দেশসহ মোট ১১টি দেশের রাষ্ট্রদূত বা কনসাল জেনারেলরা। মিয়ানমার এই প্রথম তাদের রাখাইনে বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করিয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পর তাদের বসবাস নিশ্চিত করতে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে মিয়ানমার। সেগুলো কূটনীতিকদের দেখাতে নিয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ট্রেভেলিয়ান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য যুক্তরাজ্যের অর্থায়ন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।