
প্রশাসনে ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়ছে। বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ বা দপ্তরে সিনিয়র সচিব ও সচিব মর্যাদার ১৯ কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক চাকরি করছেন। গত কয়েক মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একের পর এক সচিব অবসরের বয়সসীমা শেষে ফের চুক্তিতে স্বপদে বহাল থাকছেন। এ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সচিব হওয়ার দৌড়ে থাকা অতিরিক্ত সচিবরা এ নিয়ে বিরক্ত। চুক্তির সংস্কৃতি থেকে তারা মুক্তি চান। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার ফলে পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা বঞ্চিত হন। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কিছুটা ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। এতে মূলত রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হয়। তিনি আরও বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের ঊর্ধ্বতনদের মন রক্ষায় তাদের আদেশ-নিষেধকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তারা জনস্বার্থ চিন্তা করেন কম। ফলে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। সুতরাং রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে চুক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, একজনের চুক্তিতে নিয়োগে পদোন্নতি আটকে যায় ৪ জনের। যিনি অতিরিক্ত সচিব, তিনি সচিব হওয়ার সুযোগ হারান। যুগ্ম সচিব অতিরিক্ত সচিব হতে পারেন না। উপসচিব যুগ্ম সচিব হতে পারেন না। আর একজন সিনিয়র সহকারী সচিব উপসচিব হওয়ার সুযোগ হারান। এ কারণে প্রশাসন থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রেওয়াজ বাতিল করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। তারা আরও বলেন, নির্বাচনী বছরে সরকার বর্তমান সচিবদের ওপরই বেশি আস্থা রাখতে চায়। ফলে তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন শেষ করতে চায়। কিন্তু নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রশাসনে কাজের গতি বাড়বে। তারা নির্বাচনকালীন সরকারেও ভালোভাবে দায়িত্ব সামলাতে পারবেন।
তবে ভিন্নমত পোষণ করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তার মতে, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ও কারিগরি পদে কোনো কারণে যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া না গেলে জনস্বার্থেই চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অতীতেও ছিল, এখনো আছে। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্যই সরকারকে এটা করতে হয়।
১৯ দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক সচিব/সিনিয়র সচিব : রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগের সচিব সম্পদ বড়ুয়া, প্রেস সচিব (সচিব) জয়নাল আবেদীন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে সংযুক্ত সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান চুক্তিতে দায়িত্ব পালন করছেন। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) পদে চুক্তিতে রয়েছেন জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) পদে দুই বছরের চুক্তিতে আছেন লোকমান হোসেন মিয়া। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের চাকরি আজ ১৭ মে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এর আগেই তাকে এক বছরের জন্য একই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেনকে দুই বছরের এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদকে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন এবং রাজউক চেয়ারম্যান (সচিব) আনিছুর রহমান মিঞা আরও এক বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসকে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পদে ৩ বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এ পদে মুখ্য সচিবের মর্যাদা ভোগ করছেন। বিটিআরসির চেয়ারম্যান (সচিব) শ্যামসুন্দর সিকদারকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক পদে দুই বছরের চুক্তিতে কর্মরত আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব আখতার হোসেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীকে চুক্তিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত পদে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন সাবেক সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সাবেক খাদ্য সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ জাপানে চুক্তিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ইরাকে সাবেক সচিব ফজলুল বারী চুক্তিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন।
চলতি বছর অবসরে যাবেন যারা
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের। ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চাকরি শেষ হওয়ার কথা। প্রশাসনের শীর্ষ এ দুই পদে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে তারা দুজনই চুক্তিতে ফের নিয়োগ পেতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
৩১ মে অবসরে যাবেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম। ২৫ মে অবসরে যাওয়ার কথা ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের। তবে তাকে চুক্তিতে রাখা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। চলতি বছর স্বাস্থ্য সেবা সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব) মু. মোহসিন চৌধুরী, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আবদুস সালাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব জিয়াউল হাসান, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবুবকর ছিদ্দীক, ইআরডি সচিব শরিফা খাতুন, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী, মাদ্রাসা ও কারিগরি সচিব কামাল হোসেন, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নাসিমা বেগম অবসরে যাবেন।