কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা ফুড রিভিউ বাণিজ্যে

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা ফুড রিভিউ বাণিজ্যে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কমিউনিটি গ্রুপ সবার কাছেই অতিপরিচিত। বেশি সদস্য সংখ্যার গ্রুপগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। কারণ এসব গ্রুপে একটি পোস্ট করলে মুহূর্তেই তা লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। দেশের ফেসবুকভিত্তিক ফুড রিভিউ গ্রুপগুলোর দায়িত্ববোধ নেই বললেই চলে। কয়েকটি আবার গ্রুপের লাখো মানুষকে পুঁজি করে রিভিউ কেনার রমরমা ব্যবসা করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা আরমান শাহরিয়ার ওরফে সৌম শাহরিয়ারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত।

কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, রিভিউ কেনার ব্যবসায় সর্বাধিক আলোচিত গ্রুপ ‘ফুড ব্লগার্স বিডি’ ও ‘ফুডব্যাংক’। তাদের কাছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর তথা ফুড ব্লগার এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা জিম্মি। গ্রুপগুলোর পেইড রিভিউ দেখে রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রিভিউ ব্যবসার অন্যতম মাফিয়া প্রায় ১০ লাখ সদস্যের গ্রুপ ‘ফুড ব্লগার্স বিডি’। এর মূলহোতা সৌম শাহরিয়ার। তার বিরুদ্ধে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদাবাজি আর সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি-১৬ এবং ১৭ ভেঙে ব্যবসা করার অভিযোগ পুরোনো। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে তার চাঁদাবাজি নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট ফুড ব্লগার্স বিডি গ্রুপটি বন্ধ করে। পরে আবারও আড়ালে থেকে একই নামে গ্রুপটি চালু করা হয়। অ্যাডমিন প্যানেলেও নিজের ফেসবুক আইডি দেননি সৌম। আড়ালে থেকেই গ্রুপের যাবতীয় কার্যক্রম তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। গ্রুপটির অ্যাডমিন হিসেবে ‘ফুড ব্লগার্স বিডি’ পেইজের নাম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ছয়জন মডারেটর দিয়ে রিভিউ ও পোস্ট কেনার ব্যবসা করেন সৌম। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রয়েছে ছয়টি গোপন মোবাইল নম্বর। এর মধ্যে তিনটি নম্বর পেয়েছে কালবেলা। মার্কেটিং বা প্রমোশনের বিনিময়ে একটি পিৎজা চেইন রেস্টুরেন্টের কর্ণধারকে বানানো হয়েছে ‘মডারেটর’। ওই ব্যবসায়ীর স্বীকারোক্তি কালবেলার হাতে রয়েছে। সেই মডারেটরের দেওয়া নম্বরেই সৌম শাহরিয়ারের সঙ্গে কথা হয়। ফুড ব্লগার পরিচয়ে আরেক মডারেটর সৌরভ দেভের সঙ্গেও কথা হয়।। সৌরভও স্বীকার করেন, গ্রুপের যাবতীয় বিষয়ে সৌম সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, মাসে তিন-চার হাজার টাকা দিলে আপনার সব ভিডিও গ্রুপে প্রকাশিত হবে। আবার যে রেস্টুরেন্টের ভিডিও দেবেন তাদের সঙ্গেও আমাদের লেনদেন থাকতে হবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত আলাপ সৌম ভাইয়ের সঙ্গে করতে হবে।

এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির সাইবার অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, খণ্ডিত বা বিকৃত মতামত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা অবশ্যই অপরাধ। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সৌম শাহরিয়ারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, এই বিষয়গুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারী বিধিমালা রয়েছে। কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানালে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সৌম শাহরিয়ারের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। গ্রুপের মডারেটরদের চিনতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান সৌম। পরে মডারেটরদের চেনেন বলে একপ্রকার স্বীকারোক্তি দেন। সৌম বলেন, আমি এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত না। আপনার কাছে যদি প্রমাণ থাকে, সেটা নিয়ে এগোতে থাকেন। চুপচাপ বসে আছি, আপনাদের ভালো লাগে না। আমাকে বিখ্যাত করেই ছাড়বেন; করেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, পিছিয়ে নেই ফুডব্যাংকও। এ গ্রুপটি রিভিউর জন্য শুধু পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে অর্থ নেয়। ২০ লাখের বেশি সদস্য থাকা ফুডব্যাংকের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ আছে, প্রতিদ্বন্দ্বী রেস্টুরেন্টকে ‘অসম সুবিধা’ দিতে এমন কর্মকাণ্ড করেন গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা সাবিত হাসান। ২০১৭ সালেও বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ চেয়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল ফুডব্যাংক এবং সাবিত হাসান।

জনপ্রিয় চেইন রেস্টুরেন্ট ‘খানাস’-এর প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহিন বলেন, ফুডব্যাংকের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত কাজ হতো। একটা পোস্টের জন্য তারা ছয় হাজার টাকা নিত। আমাদের একটি ব্র্যাঞ্চের পাশে একই ধরনের আরেকটি ব্র্যান্ডের রেস্টুরেন্ট চালু হওয়ার পরে ফুডব্যাংক আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে। গ্রুপে ওই ব্র্যান্ডের নিয়মিত পজিটিভ রিভিউ দেখতে থাকি। পরে ফুডব্যাংক প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা করে মোট ১২ লাখ টাকা চায়, তাও পুরো অগ্রিম। মূলত, আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করতে ২০ গুণ দাম বাড়িয়ে অবাস্তব প্রস্তাব দেয়। এমন গ্রুপ নতুন নতুন রেস্টুরেন্টের প্রমোশনে শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু তাদের এমন কর্মকাণ্ডে একটি রেস্টুরেন্ট পথে বসতে পারে। অথচ এসব গ্রুপের কোনো জবাবদিহি নেই। তাদের দেখভালের জন্য যেন কোনো অথরিটি নেই।

অর্থের বিনিময়ে ‘রিভিউ’ কেনা রেস্টুরেন্টের খাবারের মান প্রকৃতপক্ষে যেমনই হোক না কেন, ফুডব্যাংকে সেগুলো যেন ‘সবচেয়ে ভালো’। ফুডব্যাংকের রিভিউ দেখে অনেক রেস্টুরেন্টেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার অভিযোগ রয়েছে ভোক্তা ও গ্রাহকদের। অবশ্য এ বিষয়ে গ্রুপে ভোক্তা কিছু লিখলে তাকে ‘ব্যান’ করা হয়।

একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা আহাদ চৌধুরী বলেন, ফুডব্যাংকে ইতিবাচক রিভিউ দেখে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমার নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেগুলোর কথা অন্যদের জানাতে ফুডব্যাংকে শেয়ার করলে আমাকে গ্রুপ থেকে ‘ব্যান’ করা হয়। এই গ্রুপের ইতিবাচক রিভিউগুলো ‘পেইড রিভিউ’।

গ্রুপগুলোর মিথ্যা প্রচারে গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছে এবং এগুলো প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহবুব কবীর বলেন, এই গ্রুপগুলোই মূলত প্রশ্নবিদ্ধ। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে থাকাকালে আটটি মামলায় আটটি পেইজ বন্ধ করেছিলাম। এগুলোতে মিথ্যাচার করা হয়। খারাপটাকে ভালো দেখিয়ে জনগণকে প্রতারিত করা হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন এবং নিরাপদ খাদ্য আইনে এসব গ্রুপ বা পেইজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মিথ্যা বা অসত্য বিজ্ঞাপন প্রচার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। বিষয়টিতে ডিজিটাল মাধ্যম জড়িত থাকায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে যোগাযোগ করে অধিকতর বিশ্লেষণ করব।

ফুডব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহক ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগগুলোর বিষয়ে সাবিত হাসান বলেন, আমরা কিছু রেস্টুরেন্টের সঙ্গে প্রমোশনাল কাজ করি। আর এটাও ঠিক যে, ফুডব্যাংকে রেস্টুরেন্টের নেগেটিভ রিভিউ অনুমোদিত হয় না। কারণ নেগেটিভ রিভিউর মাধ্যমে রেস্টুরেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক ভালো রেস্টুরেন্টেও একদিন গ্রাহক নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেই পারেন। কিন্তু এক দিনের কাজের জন্য তাদের প্রতিদিনের ব্যবসা খারাপ হয় না। ‘খানাস’ প্রসঙ্গে সাবিত বলেন, খানাস আমার পছন্দ না। কিন্তু ২০ লক্ষাধিক সদস্য থাকা গ্রুপে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রেস্টুরেন্টের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি সাবিত।

অন্যদিকে গ্রুপগুলোর এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ফেসবুক দায়সারা লিখিত জবাবে জানায়, পুরো বিশ্বকে একত্র করা এবং কমিউনিটি গড়ে তোলার যে উদ্দেশ্য ফেসবুকের, তার প্রাণকেন্দ্র গ্রুপ। আমরা গ্রুপ অ্যাডমিনদের অনুপ্রাণিত করি এমন নিয়ম তৈরি ও উন্নয়ন করতে যেন ব্যবহারকারীরা নিরাপদ থাকে এবং ফেসবুকে গ্রুপগুলো কী করতে পারবে আর কী পারবে না, সে বিষয়ে আমাদের কিছু কমিউনিটি গাইডলাইন রয়েছে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com