
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর মেঘনাঘাট এলাকায় অবস্থিত মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের সিমেন্ট বিক্রি হলেও বিক্রির তথ্য গোপন করা হয়েছে। প্রকৃত বিক্রির তথ্য গোপন করতে তৈরি করা হয়েছে সাতটি জাল বা নকল বিক্রয় রেজিস্টার (বিক্রয় হিসাব পুস্তক)। জাল রেজিস্টারের মাধ্যমে ১৮ মাসে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা বিক্রির তথ্য গোপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে বিক্রয় রেজিস্টার জাল করে মদিনা গ্রুপের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় ২১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা হয়েছে।
মামলায় আসামি করা হয়েছে মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. বাবুল, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন অর রশিদ খান, ব্যবস্থাপক (মূসক) মো. আতোয়ার হোসেন খান ও সিনিয়র নির্বাহী (মূসক) মাহমুদুর রহমানকে; কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিক ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমকে আসামি না করায় প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘কোম্পানির মালিক এখানে বেনিফিশিয়ারি (উপকারভোগী)। এ ঘটনার মূল অপরাধী তো মালিক।
তাকে এ ঘটনায় আসামি করা হয়নি কেন?’
ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগটি বিকল্প উপায়ে আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিট আবেদনের শুনানিকালে গতকাল সোমবার বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার ও বিচারপতি সর্দার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের কাছে এই প্রশ্ন তোলেন। হাইকোর্ট এ সময় আরও বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো ফৌজদারি মামলা হওয়ার পর এডিআর করা যায় না। আমরা আবেদনের পক্ষে কোনো আদেশ দিতে অনিচ্ছুক। পরে আদালত এ বিষয়ে আদেশের জন্য ১২ জুন দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে মদিনা সিমেন্টের আইনজীবীকে আদেশ প্রদানের অন্তত সাত দিন আগে, মামলা হওয়ার পর কীভাবে এডিআর সম্ভব—সে বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলেছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষকেও তাদের বক্তব্য এফিডেভিট আকারে দাখিল করতে বলেছেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী নাজমুস সালেহীন এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কাজী মাঈনুল হাসান। পরে আইনজীবী নাজমুস সালেহীন কালবেলাকে বলেন, আদালত রিট আবেদনটির ওপর ফের শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালিকপক্ষকে কেন আসামি করা হয়নি–এই প্রশ্ন আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে করেছেন।
ডিএজি মাঈনুল হাসান আদালতে বলেন, এডিআরের জন্য যে আবেদন করা হয়েছে তা চলবে না। যেহেতু ফৌজদারি মামলা হয়েছে সেজন্য বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক আইন-২০১২-এর ১২৫ ধারা অনুযায়ী বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) করা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিরোধ’ অর্থ আইন বা তদাধীন বিধির প্রয়োগ হতে উদ্ভূত কোনো বিরোধ; কিন্তু (জালিয়াতি বা ফৌজদারি) অপরাধ বা আইনগত প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এমন বিরোধ এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ রিট আবেদনকারীর আইনজীবী এডিআরের মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য তিন মাসের সময় চাইলেও আদালত তা নাকোচ করে দেন।
জানা যায়, গত বছরের ১০ আগস্ট বিক্রীত পণ্যের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে মূসক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে এ মামলা হয়। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে ২১ কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭২ টাকার মূসক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে সোনারগাঁ থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় কোম্পানির চার কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। কেন কোম্পানির মালিকপক্ষকে আসামি করা হয়নি সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মামলার বাদী দেলোয়ার হোসেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এনবিআর ও মামলা সূত্রে জানা যায়, মদিনা সিমেন্টের বিরুদ্ধে বিক্রয় তথ্য গোপনের অভিযোগ পায় এলটিইউ। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বের এলটিইউর ৯ সদস্যের একটি পরিদর্শক দল সোনারগাঁর মেঘনাঘাট এলাকায় মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখান থেকে পরিদর্শক দল ক্রয় হিসাব পুস্তক, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, বোট রেজিস্টার, ট্রলার ডেলিভারি রেজিস্টার, উৎপাদন ও সরবরাহ রেজিস্টার, কর চালানপত্র, একটি নকল বা জাল চালান বই, অব্যবহৃত চালান বইসহ বেশ কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করেন। এ ছাড়া পরিদর্শনের সময় পরিদর্শক দল আরও দুটি জাল বা নকল বিক্রয় রেজিস্টার বা বই (মূসক-৬.২) খুঁজে পায়। জব্দ করা ও খুঁজে পাওয়া বিক্রয় হিসাব যাচাই করে পরিদর্শক দল দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি দুটি জাল বা নকল বিক্রয় হিসাব বা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা বিক্রয় দাখিলপত্র দেখাননি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিতে জাল বিক্রয় হিসাব পুস্তক বা জাল বিক্রয় রেজিস্টার তৈরি করেছে। ফাঁকি উদ্ঘাটিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ‘মূসক আইন-২০১২’ অনুযায়ী মামলা করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, নিরীক্ষা কর্মকর্তারা জব্দ করা দলিলাদি ও প্রতিষ্ঠানের জমা দেওয়া মূসক-সংক্রান্ত দলিলাদি যাচাই করেন। তাতে দেখা গেছে, জব্দ করা সাতটি বিক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ বিক্রয়ের তথ্য প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে প্রদর্শন করেননি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিতে সাতটি বিক্রয় রেজিস্টার জাল করেছে। এই রেজিস্টারে থাকা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানটি জেনে-শুনে গোপন করেছে। জাল রেজিস্টার ব্যবহার করে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব হিসাব করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে বিক্রয় মূল্য দেখিয়েছে (রপ্তানিসহ) ৫৪৮ কোটি ৮ লাখ ১২ হাজার ৬৩৭ টাকা। যাতে মূসক দেখিয়েছে ৮১ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৩ টাকা। আর সাতটি জাল বিক্রয় রেজিস্টার অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় গোপন করেছে ১৪০ কোটি ৯২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮২ টাকা। যাতে প্রযোজ্য মূসক ২১ কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭২ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। জালিয়াতি ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ এবং বিধিমালা, ২০১৬ লঙ্ঘন করেছে।
এদিকে গত মাসে আদালতের বাইরে এডিআর পদ্ধতিতে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ নিষ্পত্তির দাবিতে হাইকোর্টে রিট করে মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। রিটে এডিআর পদ্ধদ্ধতিতে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না সে মর্মে রুল জারিরও আবেদন জানানো হয়। একই সঙ্গে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে করা মামলাটির বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখার দাবি জানানো হয়েছে এই রিটে। গতকাল এই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি হয়।