
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ লুটের মহোৎসব চলছে। চাকরির বয়স পার করার পরও সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে ‘সেশন বেনিফিটের’ নামে চাকরিতে রাখা হচ্ছে পরের বছরের জুন পর্যন্ত। ড্রাইভারদের টেকনিক্যাল অফিসার দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে সপ্তম গ্রেড। বাংলোতে বসবাস করেও বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তারাই আবার বিধিবহির্ভূত ২০ শতাংশ বিশেষ ভাতা পাচ্ছেন। শিক্ষকরা পাচ্ছেন অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট। পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে তৃতীয় গ্রেডে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি পাচ্ছেন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এভাবে অন্তত ২০টি খাতের আড়ালে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকারি অর্থ লুটপাট করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দেশের ৫৩ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনয়নে দু-এক দিনের মধ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৫৫ দফা সংবলিত সতর্কপত্র পাঠানো হচ্ছে। গতকাল রোববার কমিশনের পূর্ণ কমিশনের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, সহকারী রেজিস্ট্রাররা নবম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও নিচ্ছেন পঞ্চম বা ষষ্ঠ গ্রেডে। আর উপ-রেজিস্ট্রারের সপ্তম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও নিচ্ছেন চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে। এই ঘটনা ঘটে চলেছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তারা তৃতীয় গ্রেডে বেতন নিচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগরসহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড্রাইভারদের ‘টেকনিক্যাল অফিসার’ দেখিয়ে নবম/সপ্তম গ্রেডে বেতন-ভাতা দেওয়া হয় ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটে। নিয়োগের দিন থেকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নয়ন বা উচ্চতর স্কেল নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বুয়েট ও রুয়েটে। নানা কারণ দেখিয়ে অনর্জিত ইনক্রিমেট হিসেবে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বুয়েট, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ইসলামী এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কেউ বিশেষ ভাতা, কেউবা দায়িত্ব ভাতার নামে বেতনের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ হারে অর্থ নিচ্ছেন। বাংলো থাকার পরও বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পর বর্গফুটে কম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিটি করপোরেশনের বাইরে থাকার পরও সিটি করপোরেশন হারে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া ভাতা দেওয়া হচ্ছে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ইউজিসির ৫৫ দফা সতর্কতা: বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট (পরিচালন) বরাদ্দ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্য পালনীয় ৫৫টি গাইডলাইন দিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসির পরিপত্রে আগামী ১০ জুনের মধ্যে ৫৩ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ও নতুন বছরের প্রাথমিক বাজেট পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পরিপত্রে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে আছে—প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান)/আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ভর্তি সংক্রান্ত কাজে ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করে পরিচালন খাতে ব্যয় করতে হবে। আর এই আয় নিজস্ব আয়ের মধ্যে অবশ্যই দেখাতে হবে। এ ছাড়া ভর্তি, টিউশন, পরীক্ষা, ল্যাব টেস্ট, বিশেষ কোর্স, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে লব্ধ অর্থ ইত্যাদি অবশ্য নিজস্ব আয় হিসেবে বাজেটে দেখাতে হবে। বিভিন্ন প্রকার ব্যয়ে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট ও কর আদায় করতে হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বভাতা বেতনের ১০ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, সেটি দেওয়া যাবে। অগ্রিম দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আরও আছে, বরাদ্দকৃত এক খাতের অর্থ অন্য খাতে বা মূল খাতের কোনো অর্থ অভ্যন্তরীণ কোনো খাতে কোনোভাবেই ব্যয়/সমন্বয় করা যাবে না।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। কোনো খাতে বাড়তি অর্থের দরকার হলে ইউজিসিকে অবহিত করতে হবে। অনুমোদিত জনবলের বাইরে কোনো প্রকার নিয়োগ করা যাবে না। বিধিবহির্ভূত নিয়োগে ব্যয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই উৎসব ও নববর্ষ ভাতা গ্রহণ করবেন। চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করতে হলে তাকে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে যে, তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ভাতা নেন না। এ ধরনের জনবলকে চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কনসোলিডেট পেমেন্ট ফিক্সেশনের সময়ে কোনোভাবেই উল্লিখিত দুই ভাতা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া অ্যাডহক, দৈনিকভিত্তিক বা আউটসোর্সিং করা যাবে না। আর শূন্যপদে অনুমোদনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অনুমোদন সাপেক্ষে নিয়োগ করা যাবে।
পরিপত্রে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার বা ডরমিটরিতে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত নিয়মে আদায় করতে হবে। সুবিধাভোগীর কাছ থেকে অন্যান্য (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস) প্রকৃত বিল আদায় করতে হবে। কোনোরূপ ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। পুরাতন যানবাহন পুনঃস্থাপন, জমি/ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা বাড়ি ভাড়া, পেনশন-বিধি ও আর্থিক বিষয়ে প্রণীত নীতিমালাসহ অন্য অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে পাঠাতে হবে।
এ ছাড়া কৃচ্ছ্রসাধনের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ৯টি নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি। এর মধ্যে রয়েছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস চলাকালীন প্রয়োজন অতিরিক্ত লাইট, ফ্যান, লিফট ইত্যাদি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এসি চালু থাকলেও তার তাপমাত্রা হতে হবে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যথাসম্ভব কম সভা আহ্বান করে কমিটির কার্যক্রম সম্পাদন করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অনলাইনে ভার্চুয়ালি করার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত ই-নথি সিস্টেমে সংযুক্ত হতে হবে। যানবাহন ব্যবহার সীমিত করতে হবে। অতি জরুরি না হলে বিভিন্ন ধরনের পত্র, জার্নাল, ম্যাগাজিন, ইনভাইটেশন কার্ড ইত্যাদি ই-মেইলের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।