শেখ আবদুল্লাহ
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তা

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তা

চতুর্মুখী চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। গত কয়েক বছরের মধ্যে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি। এতে সাধারণ মানুষ জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য না থাকায় কমছে রিজার্ভ। চড়া দরে কিনতে হচ্ছে ডলার, যা আমদানি ব্যাহত করছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগও আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানে গতি নেই। খাদ্য সংকটের আশঙ্কা বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই। প্রধানমন্ত্রীও দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। ঠিক এ অবস্থায় দেশের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। দীর্ঘদিন স্থিতিশীলতার পর হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনের এই পরিস্থিতি সংকটময় অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, রাজনৈতিক দল অবশ্যই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। কিন্তু এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন, সরবরাহ ব্যাহত হয় কিংবা বৈশ্বিক বাজারে নেতিবাচক বার্তা যায়। এক কথায়, অর্থনীতিতে রাজনীতির উত্তাপের আঁচ লাগতে দেওয়া ঠিক হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির যে সংকট চলছে, তা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে। সহসাই সংকট কেটে যাবে—এমন লক্ষণও নেই। সম্প্রতি রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। এই ধারা ধরে রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। নতুবা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে ডলারের দর আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেড়ে যেতে পারে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য সহনশীল হয়, এমন মাত্রায় নামিয়ে আনা জরুরি। নতুবা দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা আরও বেড়ে যেতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে হঠাৎ কোনো সুখবর আসবে তার লক্ষণ নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এর ফলে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, সামনের দিনগুলোতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। আগামী বছর বিদায়ী বছরের চেয়ে খারাপ যাবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। হঠাৎ হঠাৎ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংঘাত হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নষ্ট করে। এতে নতুন বিনিয়োগ হবে না। এ ছাড়া সরকার যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে, সেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠান আগ্রহও দেখাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে যে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ধরে রাখা কঠিন। এ জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সমঝোতার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান কালবেলাকে বলেন, বিশ্বব্যাপী এক ধরনের সংকট চলছে। করোনার পরে অর্থনৈতিক, সামাজিক সংকট দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দেশে দেশে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জ্বালানির দাম বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এমন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলে দেবে। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে যে ব্যবসা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তা গত কয়েক বছরে প্রমাণিত। ফলে এই মুহূর্তে অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপের আঁচ লাগতে দেওয়া ঠিক হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন কোনো কর্মসূচি নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হয়।

একই মতামত জানিয়েছেন একে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান। তিনি কালবেলাকে বলেন, বর্তমান যে সংকট চলছে, তাতে অর্থনীতিতে নতুন ধরনের কোনো চাপ সৃষ্টি হয়—এমন কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে। ব্যবসা বিনিয়োগের জন্য নিশ্চয়তা, স্থিতিশীল পরিবেশ খুবই জরুরি। রাজনীতি থাকুক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে—এমন কর্মসূচি নেওয়া ঠিক হবে না।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মাদ আলী খোকন কালবেলাকে বলেন, এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। উৎপাদন, সরবরাহ সবই স্বাভাবিক রয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি চললে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে উৎপাদন সরবরাহ ব্যাহত হয়, অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়—এমন কর্মসূচি অর্থনীতির সংকট গভীর করবে।

অর্থনীতিতে যেসব সংকট : বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। প্রধান খাদ্য চালের দাম দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। আটার দামেও রেকর্ড হয়েছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, শাকসবজি, মাছ, মাংস সব কিছুর দামই চড়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ৩০ নভেম্বর দেশের রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৭৮ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বড় হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। অন্যদিকে, টাকার মূল্যমান কমেছে। চেষ্টা করেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। গত বুধবারও ডলারের বিপরীতে টাকার দর এক টাকা কমানো হয়েছে। সর্বশেষ এক ডলার কিনতে ১০৪ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আবার সরকারের সামগ্রিক আয়-ব্যয়েও ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৯০ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি ও সারে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু সরকার আর এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারছে না। এ কারণেই জ্বালানির দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখন চাপ রয়েছে সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার। এদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতির কারণে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন এমসিসিআই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সুখবর : সুখবর শুধু রপ্তানি আয়ে। সর্বশেষ নভেম্বরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবার এক মাসে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। জুলাই থেকে নভেম্বর ৫ মাসে মোট রপ্তানি আয় এসেছে ২ হাজার ১৯৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। আগামীতেও রপ্তানির এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। বিজিএমইএ সভাপতি বলেছেন, বাড়তি কিছু অর্ডার আসছে। তবে সেজন্য গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা জরুরি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিবেশেও স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। অন্যদিকে, রেমিট্যান্সও একটু একটু করে বাড়ছে। গত নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো গেলে আগামীতে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

আগামীর চ্যালেঞ্জ: বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় চাপে পড়বে। আমেরিকা ইতিমধ্যে যেভাবে সুদহার বাড়িয়েছে, তাতে চাহিদা কমবে। আর ইউরোপের কিছু দেশে ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়েছে আবার মূল্যস্ফীতিও দেখা দিয়েছে। তবে এরকম সময়ে সাধারণত কম দামের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই হিসেবে, আগামী দিনের সংকট বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাও হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ কম দামের পণ্যই তৈরি করে বেশি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আগেও বিয়ে করেছিলেন বুবলী, আছে সন্তান

৬ দিনের সফরে ঢাকা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী

দুপুরের মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টির আভাস, নদীবন্দরে সতর্কতা

ছেঁড়া নোট না নেওয়ায় ছেলেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, বাবা সংকটাপন্ন

বিয়ের কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরা হলো না তাদের

রাজধানীতে ৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

ফরিদপুরে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১২ : পুলিশ

তাপমাত্রা নিয়ে নতুন দুঃসংবাদ আবহাওয়া অফিসের

বুধবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য হ্যাটট্রিক পুরস্কার পেলেন এসি পরশুরাম জোন

১০

প্রধানমন্ত্রী আজ থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন

১১

বুধবার বন্ধ রাজধানীর যেসব মার্কেট

১২

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

২৪ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

১৪

রানা প্লাজা ধস : বিচার ও পুনর্বাসনের অপেক্ষায় ভুক্তভোগীরা

১৫

চবিতে নতুন ৫ জন সহকারী প্রক্টর নিয়োগ

১৬

পরনের কাপড় ছাড়া দরিদ্র ৫ পরিবারের সর্বস্ব পুড়ে ছাই

১৭

মিষ্টি খেতে বছরজুড়ে থাকে ভিড়

১৮

জ্ঞান ফেরেনি মায়ের, ছেলের কবরের পাশে পায়চারি করছেন বাবা

১৯

খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণ

২০
*/ ?>
X